মুহাম্মদ রুহুল আমিন, পদ্মা সেতু থেকে ফিরে : ঘড়িতে সময় বেলা ১টা বেজে ১০ মিনিট। পদ্মার ওপারে নির্মিত ভাঙ্গা স্টেশনে ট্রেনে বসা রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটনসহ অতিথিরা। সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপচেপড়া ভিড়। ভিড়ের মধ্যেই ফিতা কেটে ট্রেনে উঠলেন মন্ত্রীসহ অতিথিরা। ঠিক ১টা ২১ মিনিটে পাঁচটি বগি নিয়ে মাওয়া স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ট্রেন। বগির সাউন্ড সিস্টেমে চলছিল দেশাত্মবোধক বিভিন্ন গান। ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে/ যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই/ ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’ গানের তালে তালে ছুটে চলছে ট্রেন। ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাওয়ার পথে এটাই প্রথম ট্রেন
চলা। উপস্থিত অতিথিসহ যাত্রীদের চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। কেউ নিজের মোবাইল থেকে ট্রেনের এই পথচলা ভিডিও করছেন, কেউ ফেসবুক পেজে লাইভ করছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার দলবেঁধে সেলফিও তুলছেন। খোশগল্পে মেতেছেন মন্ত্রীসহ অতিথিরা। উপস্থিত সবার মুখেই প্রমত্তা পদ্মার হারিয়ে যাওয়া গল্প। আর ভাঙ্গা থেকে যাত্রা শুরু হয়ে মাওয়া পর্যন্ত রাস্তার দুই পাড়ে উৎসুক জনতার উচ্ছ¡াস। তারাও হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ট্রেনে থাকা অতিথিদের। কেউ কেউ আবার ট্রেন চলার ছবিও ধারণ করছেন নিজেদের মুঠোফোনে। ঠিক ২টা ৪৮ মিনিটে ট্রেনটি পদ্মা সেতুর রেল ট্র্যাকে প্রবেশ করে। ৩টা ৩ মিনিটে সেতু অতিক্রম করে। ৩টা ১৮ মিনিটে মাওয়া রেলস্টেশনে পৌঁছায় ট্রেনটি। বিকাল ৪টায় ট্রেনটি আবার সেতু পেরিয়ে ভাঙ্গায় ফিরে যায়।
মন্ত্রী ও চিফ হুইপ ছাড়াও গতকাল ট্রেনের প্রথম যাত্রী ছিলেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, সংসদ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সংসদ সদস্য ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, সদস্য ইকবাল হোসেন অপু, সাবেক হুইপ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, নাহিম রাজ্জাক, মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনসহ রেল মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী, স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা সবাই পরীক্ষামূলক ট্রেনে মাওয়া আসেন।
এর আগে ভাঙ্গা থেকে সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত পরীক্ষামূলক গ্যাংকার ট্রেন চললেও মূল সেতুতে ট্রেন প্রথম উঠল গতকালই। এর মাধ্যমে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রেন চলল। ঘণ্টায় ট্রেনের গতি ছিল ২৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর নিচের অংশ রেলের জন্য আর উপরের অংশ নির্ধারিত গাড়ি চলাচলের জন্য।
এদিকে গতকাল পদ্মা সেতুতে প্রথম ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হলেও সেপ্টেম্বরে ট্রেন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন। এমন তথ্যই জানালেন রেলমন্ত্রী।
ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ আগামী সেপ্টেম্বর মাসে চালু করা হবে বলে জানান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে রেলপথ চলাচলের জন্য উপযুক্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে সুবিধাজনক সময়ে এটি উদ্বোধন করবেন। তিনি বলেন, আজ (মঙ্গলবার) প্রথম ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে রেলপথে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে মাওয়া স্টেশনে পৌঁছেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। সড়কসেতু প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে উদ্বোধন করেছেন। ট্রেন অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে এই সেতুটি পূর্ণাঙ্গতা পেল।
যা বললেন জনপ্রতিনিধিরা : মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী বলেন, আমাদের আগের প্রজন্ম বলতে পারতেন কত কষ্ট করতে হতো। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু তাকে হত্যার পর সে উদ্যোগ থেমে যায়। এই দক্ষিণাঞ্চলে কোনো অফিসার আসতে চায়নি। ব্যবসায়ীরা নজর দেয়নি। পর্যটন কেন্দ্র থাকলেও উন্নত হয়নি, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। সামাজিক বিপ্লব হবে। অথনৈতিক দিক থেকে মাইলফলক হবে। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, শেখ হাসিনার জন্য আমরা পদ্মা সেতু পেয়েছি। সড়কপথ চালু হয়েছে। এখন ট্রেনের পরীক্ষা হলো। সড়কে যানজট হলেও রেলপথে কোনো যানজট হয় না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও কম খরচে তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা হবে। এই অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হবে। আগে ঢাকায় যেতে আমাদের দীর্ঘ সময় লাগত। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন ঢাকায় যেতে সময় লাগে না। ফেরির জন্যও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না। ট্রেন চালু হলে আরো কম সময়ে ঢাকায় যাওয়া আসা করা যাবে। সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, রেলসেতু চালুর পর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় পর্যটন ও শিল্প খাত ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে। আমরা রেললাইনটিকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত চালুর দাবি জানাই। সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, রেলে তুলনামূলক কম খরচ। অনেক মানুষ একসঙ্গে যেতে পারে। শিল্পব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। ইকবাল হোসেন অপু বলেন, আমরা কখনো ভাবিনি পদ্মার উপর দিয়ে সেতু হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সেটা বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি দক্ষিণ বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, আজকে আমরা প্রথম ট্রেন দিয়ে পদ্মা পার হচ্ছি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। নাহিম রাজ্জাক বলেন, দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে। রেলসংযোগ করার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব হবে।
যা বললেন সাধারণ মানুষ : রেললাইনে দুই পাড়ের মানুষ ছিল খুবই উচ্ছ¡সিত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন ট্রেনের যাত্রী। সাব্বির আহমেদ নামে ভাঙ্গার এক বাসিন্দা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, বলার ভাষা নেই। অনেক কষ্টে ঢাকা যেতাম। বর্ষাকালে প্রমত্তা পদ্মায় ফেরি পার হওয়ার সাহস পেতাম না। খুব প্রয়োজন না হলে ঢাকায় যাওয়া হতো না। ১০ মাস আগে সেতু চালু হওয়ায় সড়কপথে এখন প্রতি সপ্তাহে সকালে ঢাকায় যাই, বিকালেই চলে আসি। আজকে সেতুতে ট্রেন চলল। আমাদের স্বপ্নপূরণ হলো। সবকিছুর কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যার। এই অঞ্চলের মানুষ তার জন্য প্রাণভরে দোয়া করে। ট্রেনের যাত্রী হয়ে না উঠলেও শরিফুল আলম নামের মাওয়া প্রান্তের এক বাসিন্দা জানান, আগে ছিল স্বপ্ন। এখন বাস্তব। আর বলার ভাষা নেই।
২০১৬ সালের মার্চে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ঠিকাদার চীনের চায়না রেলওয়ে গ্রুপ। পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পের আওতায় চীন থেকে ১০০টি নতুন ব্রডগেজ কোচ আনা হবে। এসব কোচ দিয়ে পদ্মা সেতুর রেললাইনের ওপর ট্রেন চলবে। ইতোমধ্যে ৪৫টি কোচ বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে।
পদ্মা রেলসেতুর সার্বিক অগ্রগতি : পদ্মা রেল প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। তিনটি অংশে বিভক্ত এ প্রকল্পের মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি সব থেকে বেশি। এ অংশের অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২ দশমিক ২০ কিমি রেললাইনের পুরোটাই স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। ১৩টি মেজর ব্রিজ নির্মাণের পুরোটাই শেষ হয়েছে। ৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। ৪টি স্টেশনের সিগন্যালিং ওয়ার্কের দুটির কাজ চলমান। ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। এ অংশের কাজের মধ্যে ৩৯.৬৩ কিমি রেললাইনের মধ্যে ১২ কিলোমিটার স্থাপন হয়েছে। ৪টি স্টেশনের কাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। ১৫টি মেজর ব্রিজের মধ্যে ১৩টির কাজ শেষ হয়েছে। ভাঙ্গা-যশোর অংশের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৩ দশমিক ১৬ কিমি বাঁধ নির্মাণের অগ্রগতি ৯৩ শতাংশ। ৯টি স্টেশনের মধ্যে ৭টির কাজ চলমান, কাজের অগ্রগতি ১৭ শতাংশ। ৩২টি মেজর ব্রিজের মধ্যে ২৬টির নির্মাণ শেষ হয়েছে, ৬টির কাজ চলমান। ১৬৮টি মাইনর ব্রিজের মধ্যে ১৬১টির কাজ শেষ হয়েছে।
সংবাদ সূত্র: ভোরের কাগজ