বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর গত বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে। বছরের পর বছর ধরে বিশ্ব পরিমন্ডলে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের চিত্র ও পরিচয় পাল্টে গেছে। এটি একটি সাহায্য গ্রহীতা দেশ থেকে দাতা দেশে পরিণত হয়েছে। দেশে নীরব বিপ্লব ঘটেছে।
মহামারি করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের অর্থনীতি নেতিবাচকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে মহামারির মধ্যেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের মাধ্যমে।
বিশ্বব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থা। মহামারির প্রভাব কাটিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। ‘সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক বাউন্স ব্যাক বাট ফেস ফ্র্যাজিল রিকভারি’ শিরোনাম শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে ২০২১ অর্থ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ হতে পারে। এর পর ২০২২ অর্থ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৪.৪ শতাংশের কম হতে পারে।
এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
বাংলাদেশ যদিও মাথাপিছু জিডিপিতে এগিয়ে আছে, আয়তনের দিক থেকে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ। ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। একটি দেশের নাগরিকরা প্রকৃতপক্ষে কতটা ধনী তা বোঝার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে তাদের কতটা ক্রয় ক্ষমতা রয়েছে তা নির্ধারণ করা। অর্থাৎ সে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে সে যা খুশি কিনতে পারে। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির তুলনা করার জন্য ক্রয় ক্ষমতা সমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে জিডিপি’র আকার গণনা করা হয়। আইএমএফের মতে, পিপিপি’র ভিত্তিতে বিশ্বের জিডিপিতে ভারতের অংশ এই বছর ৭.৩৯ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ০.৬৫৯ শতাংশ।
তবে, জিডিপি’র দিক থেকে বাংলাদেশ টানা দুই বছর ভারতকে ছাড়িয়ে গেলেও কিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশকে ছাড়িয়ে গেছে সাত বছর আগে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় মেয়েদের তুলনায় বাংলাদেশী মেয়েদের শিক্ষার হার এবং মেয়েদের জন্মহার বেশি। বাংলাদেশে, শিশু এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হার ভারতের তুলনায় কম।
ভারত অনেক বড় দেশ। বিহার এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলোর পাশাপাশি দিল্লি এবং পাঞ্জাবের মতো রাজ্য রয়েছে। তাই গড়ে সবার বাস্তব চিত্র উঠে আসে না। তবে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ভালো করছে। তাই মাথাপিছু জিডিপি ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সূচকের দিকে নজর দিতে হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ, যাকে প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের চেয়ে ভাল পারফরম্যান্স করেছে বাংলাদেশ। কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত নিরাপত্তা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক অধিকার ফোরাম থিঙ্ক ট্যাঙ্ক (আইএফএফআরএএস) বলেছে, পাকিস্তান থেকে যে দেশটি পৃথক হয়েছিল সেটি এখন পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।
৩০শে জুলাই, ২০২১-এ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পূর্বে এক জাতি ছিল, আজ একটি বিশ্ব ছাড়াও’ শিরোনামের নিবন্ধে ‘ইফরাস’ বর্ণনা করেছে মহামারির আগেও কীভাবে বাংলাদেশের বৃদ্ধির হার পাকিস্তানের অনেক উপরে ছিল। ২০১৮-১৯ সালে পাকিস্তানের ৫.৮ শতাংশের তুলনায় এটি ছিল ৭.৮ শতাংশ। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ একটি ‘অলৌকিক গল্প’ এবং পাকিস্তান একটি ‘বিপর্যয়ের গল্প’ হয়ে উঠেছে।’
২০২১ সালের অক্টোবরে যখন আইএমএফ প্রথম বাংলাদেশের অগ্রগতির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তখন এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। এমনকী বাংলাদেশেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশ নিয়ে টুইট করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আইএমএফের হিসেবে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ভাল খবর হল যে, কোন উদীয়মান অর্থনীতি ভাল করবে। আশ্চর্যের বিষয়, ভারত যা পাঁচ বছর আগে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল, এখন পিছিয়ে পড়েছে। এখন ভারতের একটি সাহসী রাজস্ব ও মুদ্রানীতি দরকার।
বাংলাদেশের অগ্রগতি আকস্মিক নয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি ২০০৪ সাল থেকে অনেক দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অগ্রগতি ২০১৬ পর্যন্ত বজায় ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার দ্রুত বেড়েছে। গত ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা ২১ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ১৮ শতাংশ বেড়েছে। এসবের প্রভাব পড়ছে মাথাপিছু আয়ের ওপর। এমনকি ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের তুলনায় অর্ধেক ছিল।