১.
“আলহামদুলিল্লাহ
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার।
গত ৩/৯/২০২৪ তারিখে কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছি।
মহান আল্লাহ তাআলার কাছে নেক হায়াত ও সুস্থতা কামনা করি।
সকল আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু- বান্ধব এর কাছে আমার ও আমার মেয়ের জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি।”
৫ দিন আগে বাবা হওয়ার পর আবদুল্লাহ আল মাসুদের ফেসবুক স্ট্যাটাস।
না। তার প্রার্থনা কবুল হয় নি। হয়তো প্রার্থনা করার শুভাকাঙ্ক্ষীই ছিলো না তার। আজ থেকে ১০ বছর আগে সে যে ছাত্রলীগ করতো! তখন তার হাত পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। সে পঙ্গু ছিলো। তাই পালাতে পারে নি। ইউনূস সরকারের মেধাবী শিবির নেতাকর্মীরা তাকে আচ্ছামতো গণধোলাই দেয়। তারপরও চিকিৎসা করা যাবে না। মামলা দিতে হবে। মুমূর্ষু অবস্থায় প্রথমে তাকে ইউনূস সরকারের মতিহার থানায় নিয়ে যায়। মতিহার থানা তাকে রাখে না। বলে, তার নামে তো কোনো সহিংসতার মামলা নেই। ১০ বছর যাবত পঙ্গু একজন মানুষ, যে নিজেই বারবার শিবিরের সহিংসতার শিকার, তার নামে মামলা করা হয় নাই দেখে ইউনূস সরকার একটু বিপাকে পড়ে। মুমূর্ষু মানুষটিকে উদ্ধার না করে বরং সেই শিবির নেতাকর্মীদের হাত দিয়েই বোয়ালিয়া থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়, যাতে কোনো মামলা-টামলা দিয়ে আটক করা যায়। মাসুদ বাঁচে নি। মাসুদ মরে গেছে।
ইউনূস সরকারের (আর্মি, সুশীল, জামায়াতসহ ইসলামী দল, এবং কিয়দংশে বিএনপি) হাতে মাসুদ মারা যাওয়া নিয়ে আমার কোনো আহাজারি নেই। এমনকি কোনো অভিযোগও নেই। আর্মি ৫ই আগস্টের আগেই পুলিশকে গুলি করেছে, পুলিশকে গণহত্যা করেছে এবং করিয়েছে, যাতে আইন-শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এখন থানাগুলোয় পুলিশ কিছু থাকলেও তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের বিরুদ্ধেও আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ পুরোটাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। শিবিরের হাতে রগকাটা মাসুদের জন্য আওয়ামী লীগ কী করেছে, একটু খোঁজ খবর করি।
২.
২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলো মাসুদ আর ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক ছিলো তার বন্ধু টগর মোহাম্মদ সালেহ। তারা দুই বন্ধু একদিন রিকশায় বের হয়। জিয়া হলের পাশেই শিবির তাদের রিকশা আটকায়। ককটেল আর ফাঁকা গুলি করে। দুই দিক থেকে এসে তাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।
টগরের শরীরে ২০ থেকে ২৫টা কোপ দেয়। তারপর রগ কেটে দেয়। সে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় উঠে দাঁড়াতে পারলেও তার বন্ধু মাসুদ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ভালোভাবেই ক্ষমতায়। ২০০৯ থেকে ৫ বছর পার করে ফেলেছে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিবিরের সন্ত্রাস দূর করতে পারে নি। বা চেষ্টাও করে নি। শিবিরের মূল শক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা। সেখানে তারা বিয়েসাদি করে শক্ত ঘাঁটি বানিয়ে ফেলে। শিবিরের ছেলেরা সেখানকার মেয়েদের বিয়ে করে ঘরজামাই থাকতে শুরু করে। এলাকার লোকজনকে সাথে নিয়ে তারা হত্যা, রগকাটাজাতীয় সন্ত্রাস নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে থাকে।
সেই মাসুদ শিবিরের কাছে হাত পায়ের রগ হারিয়ে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পরও দল তার কোনো খোঁজখবর করে নি। দীর্ঘদিন সে বেকার অবস্থায় ছিলো। দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ আল মাসুদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
মাসুদ-টগরের ওপর শিবিরের হামলার বিচার আওয়ামী লীগ সরকার করে নি, করার প্রয়োজন বোধ করে নি। একজন পঙ্গু মানুষকে তাদের আর কী দরকার!
৩.
তবে আওয়ামী লীগের উচ্ছপদস্থদের দরকার ছিলো জামায়াত, বিএনপি এবং হিজবুত তাহরীরের টাকার। পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে কমিটির দায়িত্বে থাকা ছাত্রলীগের প্রায় প্রত্যেকটি নেতাই টাকার বিনিময়ে জামায়াত, হিজুর লোকজনকে পদে বসিয়েছে। সাথে ছিলো চাকুরি বাণিজ্য। বছরের পর বছর ধরে ছাত্রলীগের ছেলেদের আহাজারি শুনেছি, “ভাই, এমপি চাকরির জন্য সুপারিশ করে না। টাকা খেয়ে এই জামায়াতিকে নিয়েছে, ওই হিজুকে নিয়েছে।” সেই অভিযোগগুলো সত্য ছিলো।
সত্য যে ছিলো, তার প্রমাণ আজ ৪ সপ্তাহের মধ্যেই জামায়াত-হিজুর দখলে পুরো প্রশাসন। আজ যাদেরকে সপ্তাহের মধ্যেই ৩/৪ দফা প্রমোশন দিয়ে উচ্চপদে বসানো হচ্ছে, তারা কিন্তু সিস্টেমে আগে থেকেই ছিলো। হয়তো একদম মাথায় নিয়োগ পেতে সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সিস্টেমে থাকায় এখন একটানেই সিস্টেমের মাথায় এসে বসে গেছে।
একই অবস্থা আর্মিতেও। ৫ই আগস্টের পর আমাকে বারবার একই প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে কী করলেন? কেন আর্মিতেও এখনো এই পরিমাণ জামায়াত-শিবিরের লোক, হিজবুত তাহরীরের রিক্রুট? এই প্রশ্নের কোনো জবাব আমার কাছে নেই। শেখ হাসিনা কতোটুকু জানতেন বা পারতেন, সে প্রশ্ন তুলে রেখেই বলা যায়, আওয়ামী লীগের উপর মহলের অজ্ঞাতসারে এটি হওয়া সম্ভব ছিলো না।
গত ১০ বছরে ছাত্রলীগকেও শেষ করে দিয়েছে এই উপর মহল।
৪.
আওয়ামী লীগের পতনের জন্য দায়ী এর উপর মহল, যারা দুর্নীতি করে দলের সর্বনাশ করে গেছে। আওয়ামী লীগের শিঁকড় উপড়ে ফেলেছে, দলকে কর্মী সমর্থদের কাছ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করেছে। অন্যদিক তারা শুধু শত্রুকেই শক্তিশালী করে গেছে। শত্রু কতোটা ভয়ঙ্কর, তা বিবেচনায়ই নেয় নি। এরা এক অর্থে ধ্বংস করে গেছে নিজেদের ভবিষ্যত, ধ্বংস করে গেছে দলকে। একই সাথে ধ্বংস করে গেছে বাংলাদেশকেও। আমরা মানি বা না মানি, যতোই তত্ত্ব কপচাই না কেন, স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রেখে উন্নয়নের বাংলাদেশ বলতে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশকেই বোঝায়। আওয়ামী লীগ ডুবলে একা ডুবে না, বাংলাদেশও সাথে সাথে ডুবে যায়।
৫.
মাসুদের ৫ দিন বয়সী কন্যাসন্তানটি একদিন বড়ো হবে। বড়ো হয়ে জানবে, তার বাবা এই দেশের সবচেয়ে প্রগতিশীল দলটির রাজনীতি করতো। সে কারণে তাকে পঙ্গু হতে হয়েছিলো। সেই সন্ত্রাসের বিচার তার বাবা পায় নি। তার বাবার পাশে এসে দাঁড়ায় নি দলটি। তার বাবাকে সেই সন্ত্রাসীরা হত্যাও করেছে। বাংলাদেশ নামক দেশটি তখন নোবেলের ছদ্মাবরণে বিশ্ব-সন্ত্রাসীদের বেদখলে ছিলো। তার বাবার হত্যারও বিচার হয় নি।
মাসুদের শিশুকন্যাটি একদিন বড়ো হবে। তার গলায় গোল পাঁকিয়ে ওঠা কষ্টের দলাটি একদিন তীব্র ঘৃণায় রূপান্তরিত হবে। তার সে ঘৃণা থেকে কি বাঁচতে পারবে আওয়ামী লীগ? নোবেল ইউনূস? কিংবা বাংলাদেশ!
লেখকঃ সুশান্ত দাস গুপ্ত। দৈনিক আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক।