Close

রাশিয়া পারমাণবিক হামলা চালালে কী করা হবে, সে অবস্হায় করনীয় খুঁজছে পশ্চিমারা

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার পারমাণবিক হামলার হুমকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বিশ্লেষকদের অনেকে যদিও বলছেন, রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। তবে বসে নেই পশ্চিমা দেশগুলো। হামলার আগেই বিভিন্ন পরিকল্পনা করছে তারা।

সূত্রের বরাত দিয়ে এই তথ্য দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া যদি ইউক্রেনের ভেতরে বা কাছাকাছি এলাকায় পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, তাহলে নিজেদের দেশে যেন নৈরাজ্য দেখা না দেয় এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য করণীয় বিষয়ে পরিকল্পনা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। তারা এটা করছে অনেকটা নীরবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কীভাবে জরুরি সহায়তা দেওয়া হবে, তার কর্মপরিকল্পনাও খতিয়ে দেখছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার।নিয়ে শঙ্কিত না হতে জনগণকে আশ্বস্ত করছেন তাঁরা।

রাশিয়া পারমাণবিক হামলা চালালে মানুষের আতঙ্ক কমাতে এবং নিজ শহর ছেড়ে যাওয়া ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—গতকাল শুক্রবার এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল পশ্চিমা এক কর্মকর্তাকে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন তিনি। জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা জঘন্য একটি কাজ হবে। তবে সম্ভাব্য সব পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করছে বিভিন্ন দেশের সরকার।

পারমাণবিক যুদ্ধের সময় করণীয় নিয়ে গত শতকে নানা প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। যেমনটা হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়। সে সময় পারমাণবিক হামলা থেকে বাঁচতে স্কুলগুলোতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের প্রচারণার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডাক অ্যান্ড কাভার’। ষাটের দশকের শুরুর দিকে পশ্চিম জার্মানিতে এমন প্রচারণা চালানো হয় ‘এভরিওয়ান হ্যাজ আ চান্স’ নামে। আর সত্তরের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যে হামলা থেকে বাঁচতে ‘প্রটেক্ট অ্যান্ড সারভাইভ’ প্রচারণা চালায় সরকার।

ওই প্রচারণাগুলো সে সময় সমালোচনার মুখে পড়েছিল, খোরাক হয়েছিল হাস্যরসের। কারণ, প্রচারণাগুলোয় বলা হয়েছিল, তুমুল আকারে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে গেলেও মানুষের টিকে থাকা সম্ভব হতে পারে। এবারের পরিকল্পনার লক্ষ্য অবশ্য ভিন্ন। এখন মানুষ ভয় পাচ্ছে পারমাণবিক সংঘাত বাধলে বড় শহরগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। জনমনে এই শঙ্কা যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্যই নেওয়া হচ্ছে এসব পরিকল্পনা।

পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর নিউক্লিয়ার ডিসআর্মামেন্টের (সিএনডি) মহাসচিব কেট হাডসন। তিনি বলেন, পারমাণবিক হামলা ঘিরে যেসব পরিকল্পনার কথা উঠছে, সেগুলো স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাজ্যের ‘প্রটেক্ট অ্যান্ড সারভাইভ’ প্রচারণার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। জানালায় সাদা রং করার মতো অপ্রাসঙ্গিক নানা কাজ করে পারমাণবিক হামলার মধ্যে টিকে থাকা যেতে পারে—এমন মিথ্যা ধারণা দেওয়া হয়েছিল সেবার। ওই প্রচারণার নিন্দা জানিয়েছিল সিএনডি।

গত সেপ্টেম্বর থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ছে মস্কো, খবর আসছে দেশটিতে নিজেদের দখলে থাকা নানা এলাকা থেকে রুশ সেনাদের পিছু হটার। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত মাসে তিনি বলেন, রাশিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় ‘যেকোনো কিছু’ করতে প্রস্তুত আছেন তিনি।

পুতিনের মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলা ওই পশ্চিমা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এ ধরনের মন্তব্য করে নিজেকে ‘চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে পরিচয় দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। আর অন্য কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা তুলছে না। তাই পারমাণবিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি দেখছেন না তিনি।

সম্প্রতি রাশিয়ার পারমাণবিক হামলার হুমকি নিয়ে কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ হিসেবেই দেখা হয়। এখন রাশিয়া যদি এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে তবে তা অলিখিত ওই নিয়মের লঙ্ঘন হবে। এর জেরে রাশিয়াসহ সবাইকে চরম পরিণতির দিকে যেতে হবে।

গত মাসের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, রাশিয়া যদি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটে, তবে এর ‘পরিণতি হবে বিপর্যয়কর’। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানের কৌশলগত পারমাণবিক বোমা হিরোশিমায় ফেলা বোমার ছয় থেকে সাত গুণ বেশি শক্তিশালী হতে পারে।

রাশিয়া পারমাণবিক হামলা চালালে তার জবাব কীভাবে দেওয়া হবে, তা অবশ্য জানায়নি পশ্চিমারা। শুক্রবার যে কর্মকর্তার সঙ্গে গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনিও এ বিষয়ে চুপ ছিলেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেনে রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা হলে পশ্চিমা দেশগুলো পাল্টা জবাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না-ও করতে পারে। কারণ, পরিস্থিতি আরও সংকটের দিকে গড়াক, এটা হয়তো তারা চাইবে না।

গত বৃহস্পতিবার এই সুরেই কথা বলেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ইউক্রেনে রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা হলেও তিনি একই উপায়ে পাল্টা জবাব দেবেন না বলে জানান। মাখোঁর ভাষ্য, ইউক্রেনে যদি রাশিয়া পারমাণবিক বোমা ছোড়ে, তা ফ্রান্সের মৌলিক স্বার্থের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে না।

এদিকে যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা জিসিএইচকিউয়ের প্রধান জেরেমি ফ্লেমিং চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে বলেছিলেন, রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা চালানোর কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত পাননি তিনি। সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, পারমাণবিক হামলার হুমকি আসলে পুতিনের একটা ধাপ্পাবাজি। এর মধ্য দিয়ে তিনি পশ্চিমাদের ভয় দেখাতে চাইছেন, যেন তারা বা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে না নামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments
scroll to top