তিন বছর আগে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ধরতে গিয়ে সন্দেহবশত রুপন চৌধুরী নামে একজনকে আটক করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে দেখা যায়, রুপন পর্দার আড়ালে থাকা একজন ইয়াবা গডফাদার, মাদকের ১২টি মামলার আসামি। বিপুল অর্থবিত্তের মালিক রুপনের আয়-ব্যয় ও সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) একটি চিঠি দেয় পিবিআই।
সেই চিঠির ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নেমে দুদক রূপন ও তার স্ত্রীর প্রায় চার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে, যার কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেনি তারা। ‘ইয়াবার কারবার’ থেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া রুপনের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। এর মধ্যে একটি মামলায় তার স্ত্রী সন্ধ্যা চৌধুরীকেও আসামি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) দুদকের সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক মো. আব্দুল মালেক বাদী হয়ে মামলা দু’টি দায়ের করেন।
দুদকের সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়- ১ এর উপ পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে সঙ্গতিবিহীন অবৈধ সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলের অপরাধে এক দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। এছাড়া স্বামীর বিরুদ্ধে পৃথকভাবে আরও একটি মামলা হয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন দুইটি মাদক মামলারও আসামি।’
আসামি রুপন চৌধুরীর আদি নিবাস চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে রুপন ও তার স্ত্রী সন্ধ্যা চৌধুরীর ঠিকানা রাঙ্গামাটি পৌরসভা উল্লেখ আছে। বাসা চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানার মধ্যম নাথপাড়া এলাকায়।
জানা গেছে, পিবিআইয়ের দেওয়া চিঠির ভিত্তিতে দুদকের পক্ষ থেকে ২০২০ সালে রুপন ও সন্ধ্যা চৌধুরীকে সম্পদের বিবরণী জমা দেয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। উভয়ে সম্পদ বিবরণী জমা দিলে অনুসন্ধানে নামে দুদক।
দুদকের এজাহারে উল্লেখ আছে, সম্পদ বিবরণীতে রুপন নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার কুলগাঁও এলাকায় জমি ও শ্যামলছায়া আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটসহ ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে কুলগাঁও এলাকায় দুইতলা বাড়ি ও শ্যামলীতে ফ্ল্যাটসহ ৯৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৩৯ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পায় দুদক। দুই লাখ অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে তার নামে ২৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫২০ টাকার সম্পদের তথ্য পায় দুদক।
দুদক অনুসন্ধানে রুপনের ১ কোটি ২২ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৯ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পায়। সেইসঙ্গে ৭০ লাখ ৬০ হাজার টাকা পারিবারিক ব্যয়ের তথ্যও পাওয়া যায়। এ হিসেবে তার সম্পদের পরিমাণ এক কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৫৯ টাকা। বৈধ আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ৩১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এক কোটি ৬১ লাখ ৫১ হাজার ৯৫৯ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অবৈধভাবে উপার্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। দুদক আইনের ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছে।
এদিকে, সন্ধ্যা চৌধুরী তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে নগরীর দক্ষিণ কাট্টলীতে ২ দশমিক ৮৭ একর জমির ওপর চারতলা বাড়ির দামসহ ৫০ লাখ ৯০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের ঘোষণা দেন। কিন্তু দুদক অনুসন্ধানে স্থাবর সম্পদের মূল্য পায় দুই কোটি ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮০ টাকা। সন্ধ্যার ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের ঘোষণার বিপরীতে দুদক ৪ লাখ ২৬ হাজার ৮৮২ টাকার সম্পদের তথ্য পায়।
স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে সন্ধ্যা চৌধুরীর সম্পদের পরিমাণ দুই কোটি ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৩০ টাকা। বৈধ আয়ের উৎস পাওয়া যায় ১৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকার। এক কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪৩০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সন্ধ্যা এবং তার স্বামী রুপনকে আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের হয়েছে। দুদক আইনের ২৬ (২) ও ২৭ (১) এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রুপন বৈবাহিক এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ অর্জনের দাবি করলেও এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। বরং সম্পদের মিথ্যা তথ্য দেয়ার পাশাপাশি দুইটি মাদকের মামলা তার বিরুদ্ধে বিচারাধীন আছে। আর সন্ধ্যা চৌধুরী তার আয়সংক্রান্ত কোনো তথ্যই দুদকের কাছে উপস্থাপন করতে পারেননি। এতে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়, রুপনের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে সম্পদশালী হয়েছেন সন্ধ্যা।
২০১৯ সালের ৭ জুলাই নগরীর খুলশী থানার হলি ক্রিসেন্ট মোড়ের বাস্কেট সুপারের সামনে থেকে রুপন চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছিল পিবিআই মেট্রোর তৎকালীন পরিদর্শক ও বর্তমানে খুলশী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা।
ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মঞ্জুরুল আলম নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ধরতে গিয়ে আমরা রুপনকে পেয়েছিলাম। কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হওয়ায় নিয়ে আসা হয় পিবিআই অফিসে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে দেখা যায় সে বড় মাপের ইয়াবা পাচারকারী। তার বিরুদ্ধে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন থানায় ইয়াবা পাচারের অভিযোগে ১২টি মামলার সন্ধান পাই। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরে অঢেল সম্পদের সন্ধান পাই। এরপর পিবিআইয়ের অ্যাডিশনাল আইজি স্যারের নির্দেশে ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে রুপনের অর্জিত অবৈধ সম্পদ খতিয়ে দেখতে দুদককে চিঠি দিই।’
জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাদকের ব্যবসা করে অনেকে বড় বড় বাড়ি বানায়, গাড়ি কেনে। পুলিশ মাঝে মাঝে তাদের ধরে জেলে পাঠায়। কিন্তু মাদকের টাকায় গড়া তাদের সম্পদ অক্ষত থেকে যায়। ইয়াবা ব্যবসার টাকায় বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া রুপনের সন্ধান যখন আমরা পাই, তখন ভাবলাম যে মাদক ব্যবসায়ীদের গোড়ায় হাত দিতে হবে। তাদের সম্পদের ওপর আঘাত করলে মাদক ব্যবসায় বিনিয়োগ কমে আসবে। এই চিন্তা থেকেই আমরা দুদককে চিঠি দিয়ে রুপনের সম্পদ অনুসন্ধানের অনুরোধ করি।’
খবর: সারাবাংলা ডটনেট