মুহাম্মদ মুহসিন: তাঁর সঙ্গে আমার দেখা প্যারিসের লা-কুন্নভের একটি বাড়িতে। সে বাড়িতে একটি মেস আছে। সেখানে কয়েকজন বাঙালি থাকেন। তাঁদের রান্নাবান্নার কাজ করেন তিনি।
তাঁর নাম ফরিদুল আলম। ডাক নাম ফরিদ। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। চেহারায় স্থায়ী বিষন্নতার ছাপ।
ফরিদের সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি যে ‘আত্মজীবনী’ শোনালেন, তা ‘রীতিমতো নভেল’। কোনো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য নয়, বরং পরিবারের সদস্যরা যাতে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্য মরিয়া হয়ে ‘দেশ থেকে দেশ–দেশান্তরে’ তাঁর ছুটে বেড়ানোর গল্পটা যে কোনো কাহিনি–লোভাতুর চিত্রনির্মাতাকেও হয়তো ‘তারপর? তারপর?’ বলতে বাধ্য করবে।
লা কুন্নভের ওই বাড়িতে ফরিদ নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে তাঁর গল্পটা যখন বলছিলেন, তখন আধুনিক সভ্যতার অভিবাসন ব্যবস্থা, পরিযায়ী শ্রমিকদের কষ্ট আর আমাদের অভিবাসন ও পাসপোর্ট সংক্রান্ত ব্যবস্থার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেন তিরের মতো আমাদের বুকে বিঁধছিল।
ফরিদের বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। বাবার নাম আমিরুল আলম। মায়ের নাম আয়শা খাতুন। গরিব বাবার সংসারে জন্ম। তাই লেখাপড়ার সাধ তাঁর পূরণ হয়নি।
দুবাই দিয়ে শুরু
২০০৩ সালে আয়ের আশায় ফরিদ পাড়ি জমিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাতের আলোঝলমল শহর দুবাইয়ে।
সেখানে পৌঁছে দেখেন বাঙালি শরীরে গতর খেটে এখানে পয়সা খুব একটা আসে না। কোনো দিন কাজ জোটে, কোনো দিন জোটে না।
কোনো মাসে বাংলাদেশি টাকায় ১০ হাজার, আর কোনো মাসে হয়তো ২০ হাজার আয় করা যায়।
এ দিয়ে নিজের খরচ শেষে দেশে পাঠানোর মতো তেমন কিছু আর হাতে থাকে না।
অথচ দেশ ছাড়ার আগে কতই না স্বপ্ন ছিল! বাবা-মাকে টাকা পাঠাবেন, সঞ্চয় করবেন আর সেই সঞ্চয় দিয়ে দেশে ফিরে বিয়ে-থা করে সুখের সংসার গড়বেন।
কয়েক বছর পার করে ফরিদের স্থির বিশ্বাস হয়, দুবাই শহরে গতর খেটে এই স্বপ্ন কোনো দিন বাস্তবের কাছেও আসবে না।
ইউরোপের স্বপ্ন
ফরিদের মনে হলো, স্বপ্ন পূরণ হবে যদি পা রাখা যায় ইউরোপের মাটিতে।
কিন্তু ফরিদ কীভাবে ইউরোপ যাবেন? কীভাবে এ স্বপ্ন তাঁর পূরণ হবে? এই স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে অল্প দিনেই ফরিদ দেখলেন, তাঁর মতো বহু ফরিদের স্বপ্ন পুঁজি করে দুনিয়াজোড়া এক রমরমা অবৈধ আদম পাচারের ব্যবসা চালু আছে।
ব্যবসাটা অবৈধ হলেও তাকে অবৈধ বলতে মন সায় দেয় না। কারণ দেশে দেশে এর সঙ্গে জড়িত আছেন হাজার হাজার পুলিশ, শত শত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এবং বড় বড় গডফাদার।
কেতাবি আইনে এ ব্যবসা যতই অবৈধ হোক, আইনি লোকজনের সায় সম্বল করেই এ ব্যবসা চলছে এবং সত্যিকারেই এই উপায়ে এশিয়া আফ্রিকার শত শত মানুষ পৌঁছে যাচ্ছে স্বপ্নের ভূমি ইউরোপের মাটিতে।
সুতরাং ‘যা করে খোদায়’ বলে ফরিদও এই পথে পা বাড়ানোর ইরাদা করলেন। অনেক ভাবাভাবি আর সাধ্যমতো তত্ত্বতালাশের পরে ধরলেন দেশেরই এক দালালকে। দালালের নাম নূর ইসলাম, তাঁর বাড়ি নোয়াখালী।
দালালের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হলো পাঁচ লাখ টাকায়। ঠিক হলো, দালাল তাঁকে গ্রিস পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। এজন্য ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হবে।
এরপর দেড় লাখ টাকা দিতে হবে ইরানে পৌঁছানোর পরে। আর তুরস্কে যাওয়ার পর অবশিষ্ট তিন লাখ পরিশোধ করতে হবে।
সেই টাকা পেলে দালালের লোকজন ফরিদকে ইউরোপে পৌঁছে দেবেন।
দুবাই থেকে ওমান দিয়ে ইরান হয়ে দুঃস্বপ্নযাত্রার শুরু
‘কন্ট্রাক্ট’ অনুযায়ী ফরিদ শুরু করলেন তাঁর স্বপ্নযাত্রা। সময়টা ২০১০ সালের শেষ দিকে। আদম ব্যবসার লোকজন দুবাই থেকে ফরিদ এবং ফরিদের মতো কয়েকজনকে একসঙ্গে তুলে দিল একটি ট্যাক্সিতে।
ট্যাক্সি পৌঁছাল ওমানের সমুদ্র-তীরবর্তী পাহাড়ি এক এলাকায়। সে এলাকার নাম ফরিদ বলতে পারেননি। যাত্রীদের কোনো ধরনের পাসপোর্ট-ভিসা না থাকলেও তাঁদের নিয়ে ট্যাক্সিটি আরব আমিরাতের সীমান্ত পার হয়ে ওমান পৌঁছাল।
কোনো সমস্যা হলো না। কারণ, দালালদের সঙ্গে সীমান্তরক্ষীদের প্রয়োজনীয় রফা করা ছিল।
ওমানের সমুদ্র-তীরবর্তী এই জায়গা থেকে ফরিদের মতো আরও জনা তিরিশেক যুবককে একত্রে তুলে দেওয়া হলো একটি বোটে।
বোট পৌঁছাল ইরানের বন্দর আব্বাসে, যাকে ফরিদ যাকে বলেছেন ‘বান্দ্রাবাস’। বন্দর আব্বাসে মাসুম নামের আরেক বাঙালি দালাল তাঁদের রিসিভ করলেন এবং কোনো ভোগান্তি ছাড়াই পাসপোর্ট-ভিসাবিহীন অবস্থায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো ইরানের অভ্যন্তরে; কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বোঝাপড়া আগেই সম্পন্ন ছিল।
ইরানে পৌঁছানোর পর দালালদের দেওয়া ইরানি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আরও দেড় লাখ টাকা ফরিদের ভাই সম্পর্কীয় একজন দুবাই থেকে জমা দেন।
ইরান থেকে তুরস্কে
ইরানে সাত দিনের মতো তাঁদের রাখা হয় বেশ আদরযত্নে। এক সপ্তাহ পর তাঁদের ইরান থেকে প্রথমে ট্যাক্সিতে ও পরে বাসে নিয়ে যাওয়া হয় তুরস্কে।
ইরানের বন্দর আব্বাস ত্যাগ করার পরে কোন কোন শহর হয়ে কোন পথে তাঁদের তুরস্কে নিয়ে যাওয়া হয়, তা ফরিদ বলতে পারেন না।
ইরান-তুরস্ক সীমান্তের বা চেকপোস্টের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া ছিল বলে এই সীমান্ত অতিক্রম করতেও ফরিদ বা তাঁদের বহরের অন্যদের কোনো বেগ পেতে হয়নি।
এমনকি ইরানে তাঁদের সহযোগিতা দিয়েছেন যে দালালেরা, তাঁদের একজন তুরস্ক পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তুরস্কের অভ্যন্তরে।
তুরস্কের সীমান্ত পার হওয়ার পর প্রথমে ট্যাক্সিতে ও পরে বাসে করে তাঁরা ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে রওনা হন। পথে পুলিশ বাস থেকে তাঁদের নামিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
তাঁরা আবার ফিরে আসেন তুরস্কের সীমান্তে। দালাল আবার তাঁদের আশ্রয় দেন এবং কিছুদিন পরে আবার ইস্তাম্বুল পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এবারও পুলিশের হাতে তাঁরা ধরা পড়েন।
এভাবে ইস্তাম্বুল যাওয়ার পথে ছয়বার তাঁরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ছয়বার পুলিশ তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেয় এবং ছয়বারই পুনরায় দালালের লোকজন তাঁদের ইস্তাম্বুল পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ছয়বারের পর সপ্তমবারে তাঁরা পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত পৌঁছাতে সমর্থ হন। ইস্তাম্বুলে এক বাঙালি তাঁদের রিসিভ করেন।
ইস্তাম্বুলে অবশ্য থাকা-খাওয়ায় সেই ইরানি কদর আর জোটে না। এক রুমে গাদাগাদি করে অনেককে রাখা হয় এবং বাইরে বেরোতে দেওয়া হয় না।
এক মাসের বেশি সময় এখানে তাঁদের এভাবে পড়ে থাকতে হয়। এখানে থাকতেই চুক্তির বাকি টাকা দালাল তথা পাচারকারীদের দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করা হয়।
এক মাসের বেশি সময় এখানে থাকার পর ফরিদসহ আরও অনেক ব্যক্তিকে একটি বদ্ধ লরির মতো গাড়িতে তোলা হয় গ্রিসে পৌঁছানোর জন্য। এই গাড়ির ধারণক্ষমতা বড়জোর ২৫-৩০ জন। কিন্তু এই গাড়িতে শ খানেকের মতো লোক ওঠানো হয়। ফরিদের ভাষ্যমতে, সে এক বিভীষিকাময় যাত্রা। গাড়িতে শ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষ মরে যাওয়ারই কথা।
তুরস্ক থেকে গ্রিস
গ্রিসে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় ‘আদম সংখ্যা’ পূরণ হওয়া, লরি ড্রাইভারের সঙ্গে চুক্তি করা, সীমান্ত ও বিভিন্ন চেকপোস্টের কর্মচারীদের সঙ্গে বোঝাপড়া ও তাঁদের গ্রিন সিগন্যাল ইত্যাদির সমন্বয় ঘটাতে অনেক সময় লেগে যায়।
এক মাসের বেশি সময় এখানে থাকার পর ফরিদসহ আরও অনেক ব্যক্তিকে একটি বদ্ধ লরির মতো গাড়িতে তোলা হয় গ্রিসে পৌঁছানোর জন্য।
এই গাড়ির ধারণক্ষমতা বড়জোর ২৫-৩০ জন। কিন্তু এই গাড়িতে শ খানেকের মতো লোক ওঠানো হয়। ফরিদের ভাষ্যমতে, সে এক বিভীষিকাময় যাত্রা। গাড়িতে শ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষ মরে যাওয়ারই কথা।
তারপরও আল্লাহর রহমতে কেউ মারা যাননি। ফরিদুল আলম মনে করেন, এই বদ্ধ গাড়িগুলোকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেওয়া হয়েছিল; কারণ সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিতদের সঙ্গে এই পাচার চক্রের সমঝোতা ছিল।
সীমান্ত অতিক্রমের পর যেখানে তাঁদের নামানো হয়, সেখান থেকে গ্রিসের সেনাবাহিনী বা সীমান্তরক্ষীরা তাঁদের ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়।
পরে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার লোকজন তাঁদের নিয়ে শরণার্থীশিবিরে স্থান দেন।
এথেন্সে শরনার্থী জীবন, পুলিশ ধরে আর ছাড়ে
এই শরণার্থীশিবিরে দিন দশেক থাকার পর তাঁদের ‘স্টে পেপার’ নামে একটি ডকুমেন্ট দেওয়া হয়। এই স্টে পেপার হাতে নিয়ে তাঁরা একটি বাসে চড়ে এথেন্সের উদ্দেশে রওনা হন।
ইস্তাম্বুল থেকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় পাচারকারীরা তাঁদের হাতে জনপ্রতি ৬০ ইউরো দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই টাকায় বাসের টিকিট কিনে তাঁদের এই এথেন্স-যাত্রা শুরু হয়।
এথেন্সে এসে ফরিদুল স্টে পেপার নিয়ে কোর্টে যান অ্যাসাইলাম চেয়ে আবেদনের জন্য।
উল্লেখ করার মতো বিষয়, গ্রিসে থাকার সময় সব অ্যাসাইলামের আবেদনে ফরিদ নিজেকে রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়েছিলেন, কারণ পাচার চক্রের দালালেরা পরামর্শ দিয়েছিল, এই পরিচয়ে অ্যাসাইলাম সহজ হতে পারে।
আদালত ফরিদের অ্যাসাইলাম আবেদন গ্রহণ না করে স্টে পেপারে ছবি লাগিয়ে একটি সিল দিয়ে দেন। এই পেপার তাঁকে এক মাস থাকার বৈধতা দেয়। কিন্তু এই পেপার নিয়ে তিনি কিছু একটা রোজগারের কাজ শুরু করেন।
কাগজের বৈধতা শেষ হওয়ার পর একসময় পুলিশ ফরিদকে ধরে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে কিছু লোক এথেন্সে পরিচিত হওয়ায় তাঁদের সহযোগিতায় এক উকিল ধরা হয়।
উকিল থানায় গিয়ে আইনি কিছু পদক্ষেপ নেন এবং সে সুবাদে আবার এক মাসের স্টে পেপার দিয়ে দু-তিন দিন পরে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়।
ছাড়া পেয়ে এবার ফরিদ নিজেই অ্যাসাইলাম উকিলের দ্বারস্থ হন। আবার অ্যাসাইলামের আবেদন করা হয়। অ্যাসাইলাম না মিললেও এবার তিনি একটি লাল কার্ড পান।
এ কার্ডের পারিভাষিক নাম ফরিদ বলতে পারেন না। তবে তিনি বলেন, এই লাল কার্ড নিয়ে এথেন্সে অনেকে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন।
এই লাল কার্ড থাকলে মাঝেমধ্যে পুলিশি হয়রানি সহ্য করতে হলেও একেবারে ডিপোর্টেড হতে হয় না।
এথেন্সে লাল কার্ড পাওয়ার পর উকিলের সুবাদে অ্যাসাইলামের জন্য ফরিদুল চার-পাঁচবার ইন্টারভিউ দিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য তাঁর কখনোই প্রসন্ন হয়নি।
অ্যাসাইলামের কাগজ তাঁর কখনো জোটেনি। তাই সময়ে-অসময়ে থানায় চলে যাওয়া, হকারির জিনিসপত্র পুলিশের হাতিয়ে নেওয়া, ইত্যাকার ঝক্কি-ঝামেলার মধ্য দিয়েই স্বল্প আয়ে চলতে থাকে তাঁর এথেন্সের দিনগুলো।
একধরনের অবৈধ নিবাসের মধ্য দিয়ে হকারি বা কায়িক শ্রম দিয়ে যা যৎসামান্য রোজগার করতে পারেন, তা দিয়ে নিজের পেট চালিয়ে আর তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
ফলে দেশে বাবা-মা-ভাইবোনের জন্য কিছু পাঠানোও সম্ভব হয় না।
জীবন বাজি রেখে ইউরোপে পৌঁছে যে স্বপ্নপূরণের আশা ফরিদ এত দিন বুকের মধ্যে লালন করছিলেন, তা ধীরে ধীরে তাঁর বুকের মধ্যেই মিলিয়ে যেতে থাকে।
এথেন্স থেকে মেসিডোনিয়া–সার্বিয়া–হাঙ্গেরি
এভাবে চার-চারটি বছর চলে যায়। এর মধ্যে ২০১৪ সালের শেষ দিকে মানবতার এক মহাবিপর্যয় ফরিদুল আলমের মরতে বসা স্বপ্নের গোড়ায় বেঁচে ওঠার জন্য যেন আচমকা এক ঘটি পানি ঢেলে দিল।
সিরিয়ার ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের কারণে জীবন বাঁচাতে মানুষের স্রোত তখন ধেয়ে আসে ইউরোপের দিকে।
জার্মানিসহ অনেকগুলো পূর্ব ইউরোপের দেশ তাদের সীমান্ত খুলে দেয় এই শরণার্থীদের জীবন বাঁচাতে।
ফরিদ ভাবলেন, হয়তো আল্লাহ তাঁর আপাত-অবোধ্য জটিল কর্মপ্রক্রিয়ার ধারায় এত দিনে তাঁর স্বপ্নের প্রতি মুখ তুলে তাকিয়েছেন। তিনি আবার পথে নামলেন। এই জনতার সঙ্গে মিশে তিনি এবার ঢুকতে চেষ্টা করলেন পশ্চিম ইউরোপের দেশ জার্মানি, সুইজারল্যান্ড বা ফ্রান্সে।
২০১৪ সালের শেষ দিকে তিনি তাঁর প্রায় নিভে যাওয়া স্বপ্ন বাঁচিয়ে তোলার আশায় এত দিনের আয়রোজগার থেকে সঞ্চিত টাকা পয়সাটুকু ট্যাঁকে গুঁজে এথেন্স থেকে যাত্রা শুরু করলেন।
সঙ্গে আরও দু-তিনজন বাঙালির সঙ্গে বাসে রওনা হয়ে ফরিদ প্রথমে এলেন মেসিডোনিয়ায়।
সেখান থেকে আরেক বাসে সার্বিয়া এবং তারপর আরেক বাসে সার্বিয়া থেকে হাঙ্গেরি।
হাঙ্গেরিতে ঢোকার সময় ফরিদ এথেন্সে পাওয়া তাঁর লাল কার্ডটি ফেলে দেন।
হাঙ্গেরিতে তাঁরা যে বাসে পৌঁছেছিলেন, সে বাস ভর্তি ছিল আফগানি, পাকিস্তানি আর বাঙালি শরণার্থীতে।
হাঙ্গেরিতে পুরো শরণার্থীর এই বাসটি নিয়ে যাওয়া হয় একটি রিফিউজি ক্যাম্পে।
ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ তাঁদের দুই সপ্তাহ ওই ক্যাম্পে অবস্থানের জন্য একটি ডকুমেন্ট দেয়। কিন্তু ফরিদ এই ক্যাম্পে ১৫ দিন না থেকে অস্ট্রিয়ায় ঢোকার নিয়তে ক্যাম্প ত্যাগ করেন।
টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠে ঘুম, গন্তব্য জার্মানি, গেলেন চেক রিপাবলিক
জার্মানি যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে তিনি অস্ট্রিয়ায় এক দিন থাকেন। সেখান থেকে টিকিট কেটে তিনি জার্মানির উদ্দেশে ট্রেনে ওঠেন।
এত দিনের খাওয়া-না-খাওয়া আর টেনশনের ভ্রমণে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটি ট্রেনে উঠে সিটে বসার কিছু সময়েই ঘোর ঘুমের রাজ্যে চলে যায়।
সে ঘুম ফরিদকে স্বপ্নের পরিবর্তে উপহার দেয় কঠিন দুঃস্বপ্ন। তাঁর গভীর ঘুমের মধ্যে কোথায় কী হয় তিনি বলতে পারেন না। তাঁর ঘুম ভাঙে পুলিশের ডাকে।
পুলিশ তাঁকে ট্রেন থেকে এক স্টেশনে নামিয়ে দেয়। ট্রেন থেকে নেমে তিনি ধীরে ধীরে বুঝে উঠতে পারেন, তিনি যে দেশে নেমেছেন, সেটি তাঁর স্বপ্নের দেশ জার্মানি নয়, বরং সেটি অন্য দেশ; চেক রিপাবলিক।
চেক রিপাবলিকে পুলিশ ফরিদকে থানায় নিয়ে যায়। থানা হেফাজতে তাঁকে আট-দশ দিন চেক রিপাবলিকে রাখা হয়।
এরপর হেফাজতে নেওয়া অনেকগুলো মানুষের মধ্যে কাউকে অস্ট্রিয়ার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর কাউকে হাঙ্গেরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ফরিদের ক্ষেত্রে ঘটে একটি ভিন্ন রকম ঘটনা।
থানা হেফাজতে পুলিশ ফরিদের ব্যাগে-পকেটে টাকাপয়সা ও কাগজপত্র যা পায়, তা নিয়ে নেয়। তাঁর আশা ছিল, ইউরোপের পুলিশ বাঙালিদের মতো হবে না।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সবই আবার তাঁকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু এই পুলিশ তাঁর কিছুই আর ফেরত দেয় না। তবে অন্যদের মতো তাঁকে অস্ট্রিয়ায় বা হাঙ্গেরিতে ফেরতও পাঠায় না।
বরং তাদের গাড়িতে করে নিয়ে দূরে একটি ছোট ট্রেন স্টেশনের কাছে নামিয়ে দেয় আর ইশারায় দেখিয়ে দেয় কোন দিকে গেলে অস্ট্রিয়ায় ফেরত যাওয়া যাবে, আর কোন দিকে গেলে জার্মানির উদ্দেশে অগ্রসর হওয়া যাবে।
তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে এক আরব লোকের সঙ্গে এই ট্রেনে তাঁর দেখা হলো। দুবাইয়ে শেখা কিছু আরবি শব্দের ওপর ভর করে এই লোকটিকে তাঁর অবস্থার কথা কিছুটা বোঝাতে পারলেন। আরব লোকটি তাঁকে একটি বড় স্টেশনে নামিয়ে দিলেন এবং বললেন এই স্টেশন থেকে ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাকার ইউরোপের যেকোনো দেশে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যাবে।
খালি পেট আর খালি পকেটে ফের জার্মানির পথে, ফের ট্রেনে ঘুমিয়ে পুলিশের হাতে
আবারও ফরিদ জার্মানিমুখী ট্রেনে ওঠার ইরাদা করলেন। কিন্তু কীভাবে উঠবেন? তাঁর হাতে তো কোনো টাকা নেই ট্রেনের টিকিট কাটার।
কী আর করা? বিনা টিকিটেই উঠে পড়বেন, যা করে খোদায়। ঠিকই তা-ই করলেন। পুলিশের দেখানো দিকের ওপর ভর করে একটি ট্রেনে উঠলেন। ট্রেনটিতে লোকজন খুব কম।
তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে এক আরব লোকের সঙ্গে এই ট্রেনে তাঁর দেখা হলো। দুবাইয়ে শেখা কিছু আরবি শব্দের ওপর ভর করে এই লোকটিকে তাঁর অবস্থার কথা কিছুটা বোঝাতে পারলেন।
আরব লোকটি তাঁকে একটি বড় স্টেশনে নামিয়ে দিলেন এবং বললেন এই স্টেশন থেকে ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাকার ইউরোপের যেকোনো দেশে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যাবে।
ফরিদ এই স্টেশনটির নাম অবশ্য বলতে পারেননি।
এই স্টেশনে যখন ফরিদ নামলেন, তখন তাঁর পেটে অনেক ক্ষুধা। কিন্তু খাবার পাবেন কোথায়? তাঁর পকেটে তো কোনো খাবার নেই। কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না।
তীব্র ক্ষুধায় কারও কাছে কিছু চাইতে পারছেন না। কারণ তাঁর এখানকার কোনো ভাষাই জানা নেই।
এভাবে কাটছে অসহায় সময়। এমন সময় তাঁর মনে হলো, আল্লাহ অনেক দয়ালু হয়ে একটি লোক তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরেকজন আরব। ফরিদ তাঁর ক্ষুধা ও অসহায়ত্বের কথা ইশারা ইঙ্গিতে এই লোকটিকে বললেন।
আরব লোকটি দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে একখানি ১০০ ইউরোর নোট দিলেন এবং বলে দিলেন জার্মানিগামী ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্মে থামবে।
তাঁর নির্দেশনামতো ফরিদ এবার জার্মানিগামী ট্রেনেই উঠলেন। এবারও বিনা টিকিটে। পকেটে সম্বল তো মাত্র ১০০ ইউরো। টিকিট কিনে সেটা শেষ করলে তারপর কী হবে?
ট্রেনে ওঠার পর ক্লান্ত ও শ্রান্ত শরীরে আবারও একই রকম ঘুম। যখন ঘুম ভাঙে তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন পুলিশের হাতে।
পুলিশ তাঁকে এবার আরেকটি স্টেশনে নামিয়ে দেয়। ফরিদের বক্তব্যমতে এটি ছিল জার্মানির ‘মুনশিয়ান বর্ডার’। গুগল ম্যাপে এ রকম বর্ডারের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না।
ফরিদ অক্ষর চেনেন না, তাই বানানও বলতে পারেন না। তবে চেক রিপাবলিকের কাছে ভাল্ডমুশেন নামে একটি শহর গুগল ম্যাপে দেখা যায়।
ফরিদের বলা ‘মুনশিয়ান বর্ডার’ এই শহরটিও হতে পারে। স্টেশনে নামান পর পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।
সেখানে ফরিদের জন্য একটি অ্যাসাইলাম ফাইল খোলা হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে তাঁর দাখিলকৃত একটি আবেদন নথিতে তোলা হয়।
এক আফগানি ভদ্রলোককে তাঁর দোভাষী নিযুক্ত করা হয়।
শরনার্থী শিবিরে
এই ফাইলের সাপোর্টে ফরিদকে একটি উদ্বাস্তু শিবিরে তোলা হয়। ক্যাম্পের শহরটির নাম ফরিদ বলছেন রেজবিন। কিন্তু যথারীতি এই নামের কোনো শহরও গুগলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জার্মানিতে।
হয়তো ফরিদ ভাই মানুষের মুখে শোনা নাম সঠিক উচ্চারণে রপ্ত করতে পারেননি, আর তাই-ই হয়তো মূল নামটি আমরা সঠিক বানানে লিখতে না পারায় গুগলও আমাদের সাহায্য করছে না।
এ ক্যাম্পে থাকাকালে তাঁর অ্যাসাইলামের আবেদন বিবেচনায় ফরিদের জন্য একজন আফগান দোভাষীও নিযুক্ত হয়। কিন্তু আবেদন নামঞ্জুরই থেকে যায়।
এরপর বাসে করে তাঁকে ও ক্যাম্পের আরও অনেককে আরও বড় উদ্বাস্তু শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ফরিদ শহরটির নাম বলেছেন—কেমরুজ। এই নামে কোনো শহরও আমি গুগলে পাচ্ছি না।
তাঁর বর্ণনামতে শহরটি মোটামুটি বড় এবং সেখানকার উদ্বাস্তু শিবিরটিও বেশ বড়।
এখানেই তিনি প্রথম দেখলেন, উদ্বাস্তু শিবিরেও শরণার্থীদের জন্য সুন্দর ওয়াশরুমসহ সুন্দর খাট ও ভালো খাবার থাকতে পারে।
অবশ্য এই উন্নত শিবিরেও তাঁর এক সপ্তাহের বেশি থাকা হয় না। এক সপ্তাহ পরে তাঁকেসহ অনেককে এক বাসে করে নিয়ে আসা হলো পশ্চিম জার্মানির একসময়ের রাজধানী বন শহরে।
ইউরোপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা শেষ, পরিচয়হীন জীবন
বছরের পর বছর নিজের ও পরিবারের সুখের দিনের স্বপ্ন বয়ে এমন বুকভাঙা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ফরিদ শেষ পর্যন্ত নিজেকে সব আশা ও স্বপ্ন থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলেন।
জীবনের অসহনীয় বেদনা ও বঞ্চনার ঘটনাপুঞ্জ তাঁর সব স্বপ্ন ও আশা ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে সমাহিত করে দিল যেন।
তিনি বুঝতে পারলেন, দুনিয়ায় সব মানুষের জন্য আল্লাহ স্বপ্ন রাখেননি। এবার তাই সব স্বপ্ন ও আশা তিনি ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে শুধু মসজিদমুখো হলেন।
ক্যাম্প থেকে আর পালানোর কোনো চেষ্টায় তিনি নামলেন না। এখন ক্যাম্প থেকে পাওয়া মাসিক ৩৫০ ইউরো দিয়ে নিজের পেট চালান আর মসজিদে গিয়ে আল্লাহকে ডাকেন। আর আল্লাহর কাছে মাফ চান বান্দা হয়ে এমন সুখের দিনের স্বপ্ন দেখার গোস্তাখির জন্য।
২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এভাবে জীবন কাটিয়ে তাঁর মনে হলো ইসলামি জীবন যাপনের বন শহরের চেয়ে প্যারিস হয়তো আরেকটু ভালো হবে।
অনেকে বলল, প্যারিসে অ্যাসাইলামের দরখাস্ত করলে আবেদন মঞ্জুরের সম্ভাবনাও নাকি বেশি।
শেষ ঠাঁই প্যারিসে, পাসপোর্ট নেই, পরিচয় নেই
২০১৮ সালে ফরিদ চলে এলেন প্যারিসে। এখানেও আবার অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন দাখিল করেন। কিন্তু যথারীতি তাঁর আবেদন এখানেও নামঞ্জুর হয়। তবে মঞ্জুর-নামঞ্জুরের এই প্রক্রিয়ায় তাঁর ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর চলে যায়।
এ নিয়ে অবশ্য ফরিদের তেমন কোনো আফসোস নেই। তিনি আর অ্যাসাইলাম চানও না। নিজের একটি প্রতিষ্ঠিত জীবনও আর তিনি চান না; মা-বাবা-ভাই-বোনের সামান্য কিছু সুখের জন্য দুটি ডলার বা ইউরোর আয়ও তিনি আর চান না; এমনকি বিয়ে-শাদির মাধ্যমে একটি নারীর সান্নিধ্যে পুরুষের জেগে ওঠার অতি ন্যায্য সুখটুকুও তিনি আর চান না।
আজ ফরিদুল শুধু একটু কাগজ চান, যার বলে তিনি বলতে পারবেন, তাঁরও একটি দেশ আছে, একটি জন্মভূমি আছে এবং সেখানে ফেরার তাঁর অধিকার আছে।
ফরিদ এখন লা কুন্নভের একটু মেসে রান্নাবান্নার কাজ করেন। পাশে আনওয়ার–এ–তৈয়বা নামের একটি মসজিদ আছেন। সেখানে বেশিরভাগ সময় কাটান। আর প্রতি শুক্রবার মসজিদের সামনের ফুটপাতে অল্প কিছু টুপি–তসবিহ নিয়ে বিক্রি করতে বসেন।
তবে ফরিদের জাগতিক জীবনে প্রতিষ্ঠার সব আশা শেষ হয়ে গেলেও নিজের দেশে মরার আশা শেষ হয়নি।
জীবনের শেষবেলায় সেই আশাটুকু নিয়ে ফরিদ গিয়েছিলেন প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে। তিনি সেখানে প্রার্থনা করলেন, একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট; যেটি থাকলে তিনি বলতে পারেন তাঁর একটি দেশ আছে এবং সেখানে যাওয়ার তাঁর অধিকার আছে।
দূতাবাস কর্তৃপক্ষ তাঁর আবেদন রাখল, তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্ট রাখল। তারপর অনেক দিন ঘুরিয়ে তাঁকে বলল, তাঁর পুরোনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট জমা না দিতে পারলে তাঁরা তাঁকে কোনো নতুন পাসপোর্ট দিতে পারবে না।
কিন্তু ফরিদ কোথায় পাবেন তাঁর সেই পুরোনো পাসপোর্ট। সেটি তো তাঁকে ফেলে দিতে হয়েছে দুবাই থেকে তাঁর যাত্রা শুরুর সঙ্গেই। ওটি হাতে রেখে তো অ্যাসাইলামের আবেদনই করা যায় না।
বাংলাদেশের মানুষ-বাবা-মা-দাদা-দাদি চৌদ্দ পুরুষ যাঁর বাংলাদেশি, সে আজ একটি কাগজের অভাবে বাংলাদেশি বলে নিজেকে দাবি করতে পারছে না।
হয়তো সমস্যাটি কাগজ না থাকার মধ্যে নয়। হয়তো রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থিতার দ্বারা দেশের ওপর যে কালিমা লেপন হয়েছে, সেই কারণেই দেশ হয়তো তাঁকে অস্বীকারের পথে এগোচ্ছে।
কিন্তু দেশের এ-সংক্রান্ত কর্তাদের কি একবার ভেবে দেখা উচিত না যে, ফরিদুল আলমরা দেশের বিরুদ্ধে বলতে বা দেশের রাজনৈতিক অপচর্চা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে এমন পদে পদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার পথে পা বাড়ান না?
ফরিদের শেষ ইচ্ছা
প্রতি পদে জীবনকে বাজি রেখে এবং দেশের সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা বলে বলে প্রাণান্তকরভাবে তাঁদের একটিই আকাঙ্ক্ষা, আর তা হলো ইউরোপের মাটি থেকে দুটো ডলার বা ইউরো উপার্জন করে দেশের আপনজনের কাছে পাঠানো আর সেই আপনজন তথা দেশবাসীর সামগ্রিক সুখের সূচকটি একটু এগিয়ে নেওয়া।
সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে অসমসাহস নিয়ে কেউ ওঠে ভূমধ্যসাগরের অবৈধ বোটে আর অহরহ সেই বোট ডুবে যায় আর তাঁদের মৃতদেহ হয়ে যায় ভূমধ্যসাগরের মাছ ও হাঙরের খাবার।
কেউ অর্থহীন-বস্ত্রহীন অবস্থায় ওঠে গ্রিসের উপকূলে। আর সেখানে বস্ত্রহীন তাঁদের শরীর কঠিন শীতে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অনেকটা তাঁদেরই একজন ফরিদুল আলম।
বাংলাদেশে আবাল্যলালিত প্রিয় মুখগুলো থেকে এভাবে চিরতরে হারিয়ে না যেতে তাঁর করুণ আকুতি নিজ দেশের একটি পাসপোর্টের জন্য।
আমাদের প্যারিস দূতাবাস এবং আমাদের পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কি ফরিদুলের কষ্টের ভাগ নেবেন?
কেউ কি একটু ভেবে দেখবেন নিজ দেশের একটু সুখের জন্য জীবন বিপন্নকারী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্যর্থ ও পরাজিত এই মানুষটিকে তাঁর নিজ দেশের আপন মানুষের কাছে এসে মরতে চাওয়ার সুযোগ করে দিতে কীভাবে একটি পাসপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা যায়?
এমন মানুষ নিশ্চয়ই আছেন। সেই মানুষটির জন্য ফ্রান্সের একটি মোবাইল নম্বর (+ ৩৩৭৫৩৭১৮৩২৮) রাখলাম যা দিয়ে ফরিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।
ড. মুহম্মদ মুহসিন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।
সূত্র: প্রথম আলো অনলাইন।