জয়বাংলা প্রতিদিন ডটকম ডেস্ক: সংকট, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৭৫বছর অতিক্রম করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা। চার দশক ধরে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন চতুর্থ দফায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। দেশের ইতিহাসে এমন রেকর্ড আর কারও নেই।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেই দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে উদ্যাপন করছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন তিনি। পার্বত্য চুক্তি, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়সহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে তাঁর সময়ে।
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হয়েছে। মিয়ানমারে নৃশংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে যে মানবিকতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। এ ছাড়া দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিতে তিনি রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ ও ভৌত উন্নয়নের জন্য তিনি ১০০ বছরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, যা ‘ডেলটা প্ল্যান’ বা ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। এরপর সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন।
শৈশব, শিক্ষা, পরিবার ও ছাত্ররাজনীতি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড়। আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় তিনি ১৯৬২ সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে পথে নেমে আন্দোলন করেছেন। তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন স্পষ্টভাষী, স্কুলে তিনি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আয়োজনেও নেতৃত্ব দিতেন।
বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের (সাবেক ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজে) ছাত্রী থাকা অবস্থায় ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হন শেখ হাসিনা। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন ১৯৬৭ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকে প্রায়ই কারান্তরীণ থাকতেন। বড় মেয়ে শেখ হাসিনার বিয়ের সময়েও তিনি কারাগারে ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের তত্ত্বাবধানেই ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর একমাত্র ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এখন প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা। মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন।
সংকটময় পথে
শেখ হাসিনার জীবনে গভীরতম সংকট নেমে এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তা ও সদস্য সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। তিনি তখন স্বামী-সন্তান, ছোট বোন শেখ রেহানাসহ অবস্থান করছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। দেশে না থাকায় সেদিন তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। তবে শুরু হয় দুঃসহ এক জীবন। প্রথমে জার্মানি এবং পরে ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে বাধ্য হন।
সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে এক ক্রান্তিকাল দেখা দেয়। জাতীয় চার নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করায় গভীর সংকট দেখা দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। দলের সেই বেসামাল পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে সভানেত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করা হয়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে আসে সেই দিন, ১৯৮১ সালের ১৭ মে। সেদিন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দলের অগণিত নেতা-কর্মী বিমানবন্দরে সমবেত হন তাঁদের সভাপতি শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে।
স্বজন হারানোর ছয় বছর পর শোকাচ্ছন্ন শেখ হাসিনা দেশের ভেজা মাটিতে পা রাখলেন। তিনি সমবেত জনতাকে বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আজ আমি এসেছি বাংলায়। এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। আমার আজ হারানোর কিছুই নেই।’ দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অন্তত ২২ বার হামলা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
সংগ্রামী পথচলা
দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম সাফল্য ছিল ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ৩০ বছরের চুক্তি এবং পাহাড়ে সংঘাত নিরসনে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এ ছাড়া কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়াও শুরু করেছিলেন তিনি।
বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের উদ্যোগ নিলে আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ। নানা সংকটময় পরিস্থিতির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দলগুলো নিয়ে গঠিত হয় ১৪-দলীয় মহাজোট। এই জোট ভোটে জয়লাভ করে।
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেন। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয়বার এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। এ ছাড়া তিনি তিন মেয়াদে সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, নারীশিক্ষায় অগ্রগতি, বিভিন্ন ভাতা ও বৃত্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক জনগণের আর্থিক সুরক্ষা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড, জিডিপির ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিসহ জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের সাফল্য রয়েছে।