শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস হলো আজ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট ভারতে চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এখনও তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর সেনাবাহিনী জানায়, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে চলে গেছেন তিনি। ফলে ভেঙে দেওয়া হয় মন্ত্রিসভা ও সংসদ।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ লোকজন। দলের এমপি-মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মুখে পড়ে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের পর নামফলক ভেঙে ফেলে ‘ছাত্র জনতার কার্যালয়’ উল্লেখ করে নতুন নামফলক টানানো হয়। অবশ্য ছাত্র-জনতা শীর্ষক নাম ফলকটি সরিয়ে আবারও আওয়ামী লীগের নামে ব্যানার লাগানো হলে সেটাও ছিঁড়ে ফেলা হয়।
এদিকে দলীয় প্রধানের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও দলের অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে স্থলপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। কেউ কেউ আকাশ পথেও বিদেশ যেতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিরা এখনও দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা-ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা (ছবি: ফয়সাল ইসলাম রাজিব)
এদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে। ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মামলার সংখ্যা শতক ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। প্রায় সব মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হচ্ছে।
দেশে আত্মগোপনে থাকাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুসহ বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে আটক ও পুলিশের রিমান্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুও গ্রেফতার হয়েছেন।
এছাড়া সাবেক সরকারের ‘সুবিধাভোগী’ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে শেখ হাসিনার বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ‘সমালোচনা’ করেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
দলীয় নেতাকর্মী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে যাওয়ার ঘটনায় তারা অনেকটাই হতাশ। এছাড়া সরকার পতনের পর শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভিডিও বার্তা এবং বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্ববিরোধী নানা বক্তব্যে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান দলের নেতাকর্মীরা।
৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা চালায় জনতা (ছবি: ফয়সাল ইসলাম রাজিব)
এরইমধ্যে কোন প্রেক্ষাপটে ও কেন পদত্যাগ করেছেন সেটা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা গত ৭ আগস্ট একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। পরে সজীব ওয়াজেদ জয় এক বিবৃতিতে ওই চিঠির বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তার মা এ ধরনের কোনও চিঠি লেখেননি। জয় এও দাবি করেন, ‘দেশ ছাড়ার সময় তিনি (শেখ হাসিনা) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেননি।’
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ও পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমের কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা জানান। তবে, সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে কোনও গেজেট প্রকাশ হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিজি প্রেস থেকেও এ সংক্রান্ত কোনও গেজেট প্রকাশিত হয়নি।
দেশ-বিদেশে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভারতে যাওয়ার দুদিন পর থেকে শেখ হাসিনা নিজেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। বিশেষ করে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনসহ ওইদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করার আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা ১৩ আগস্ট দেশবাসীকে উদ্দেশ করে একটি চিঠিও পাঠান—যা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আপলোড করেন। ওই চিঠিতে ১৫ আগস্ট পালনের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তবে আওয়ামী লীগ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতীয় শোক দিবস পালন করবে, এমন খবরে ছাত্র-জনতা ১৪ আগস্ট বিকাল থেকেই ৩২ নম্বর দখলে নেয়। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর নেতৃত্বে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন করলে আক্রমণের শিকার হন। ১৫ আগস্টও কিছু লোক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এলে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এ সময় অনেকে হামলার শিকার হন। প্রতিরোধে মুখে পড়েন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রধান কাদের সিদ্দিকীও। তার গাড়ি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া, শরীয়তপুরসহ কয়েকটি স্থানে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে ১৫ আগস্ট পালিত হয়।
তবে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর দেশের একমাত্র তার নিজ জেলা গোপালগঞ্জ ছাড়া কোথাও প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা (ছবি: ফোকাস বাংলা)
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা এখনও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তিনি তাদের নিরাপদে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে দলের পক্ষে সক্রিয় থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে—আওয়ামী লীগের এমন দুজন মধ্যম সারির নেতার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই দুই নেতা বলেন, হোয়াটসঅ্যাপে তাদের সঙ্গে দলীয় প্রধানের কথা হয়েছে। পদত্যাগ করার কারণ উল্লেখসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। তিনি তাদের সাবধানে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এমনটা জানিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই দুই নেতাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন সভানেত্রী।
শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার কয়েকটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার ‘স্বাক্ষরিত’ একাধিক বিবৃতি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আপলোড করতে দেখা গেছে। তবে এসব বিবৃতির কোনোটিরই সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক সর্বশেষ বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়সহ সারা দেশে ১০ হাজারের মতো দলীয় স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
তিনি দাবি করেন, ‘দেশি-বিদেশি সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারকে হটানো হয়েছে’। তবে নানক দেশে নাকি বিদেশে—কোথায় অবস্থান করছেন, কোথা থেকে বিবৃতি পাঠিয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে গত কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগের নামে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ও পেজে ‘আওয়ামী লীগে পরিবর্তন আসছে’ বলে পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে। এসব পোস্টে কখনও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভিকে সাধারণ সম্পাদক, আবার কখনও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে। যদিও এসব প্রচারণার কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বরং শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হয়েছে এমন এক নেতা আলাপে জানান, ‘এসব ভুয়া খবর’।
আওয়ামী নামধারী যেসব ফেসবুক আইডি বা পেজে বিভিন্ন তথ্য আপলোড হচ্ছে, সেই পেজ বা আইডি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এসব পেজ ‘ভুয়া’ বলে দাবি করে একাধিকবার বক্তব্য বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে।
সংবাদ সূত্রঃ সাংবাদিক ইমরান হোসাইন শেখ। বাংলা ট্রিঁবিউন।