Close

হারিয়ে গেছে ছাত্রদের আন্দোলনের সময় ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি টাকা ঢালা পেজগুলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা কোটা সংস্কারের ডাক দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা গণআন্দোলনে রূপ নিয়ে গত ৫ আগস্ট সরকার পতন ঘটিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মাধ্যমে দ্বাদশ সংসদের পতন ঘটানো এই আন্দোলনে অন্যতম বড় ভূমিকা রেখেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গত ১০ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে শুধু ফেসবুক বিজ্ঞাপনেই ৬৩ হাজারের বেশি ডলার ব্যয় করা হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা ফেসবুক পেজগুলো এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

টুইটার, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আওতায় পড়লেও বাংলাদেশে গণআন্দোলনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল ফেসবুক। আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে খবর জানতে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের চেয়ে ফেসবুককে ভরসা মেনেছে তরুণ প্রজন্ম। অন্য প্রজন্মও মার্ক জাকারবার্গের সৃষ্ট ওয়েবসাইট ব্যবহারে পিছিয়ে ছিলেন-এমন নয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ের প্রথম থেকে বেগ পেয়েছিল। ১০ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচিতে ছাত্ররা দেশজুড়ে নিজেদের ক্ষোভ ও শক্তিটা দেখিয়ে দেন।

গত ১৪ জুলাই সংবাদসম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয় সবখানে। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, ১৭ জুলাই পুলিশের গুলিতে ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু, ধাপে ধাপে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের শপথ গ্রহণ।

স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ফেসবুকের প্রভাব টের পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। এবং ফেসবুক বিজ্ঞাপনকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে বহু পেজ।

ফেসবুকের মাধ্যমে জনমত গড়ে ওঠা ও আন্দোলন তীব্র হওয়ার ফল ১৮ জুলাইয়ে ভালোভাবে টের পাওয়া গিয়েছিল। সহিংসতায় সারা দেশে ব্যাপক প্রাণহানির পর ১৮ জুলাই সকাল থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল বিগত সরকার। ওই দিন সন্ধ্যার পর মহাখালীর ডেটাসেন্টারে আগুন লাগার অজুহাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গত ২৩ জুলাই রাতে আবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত পরিসরে চালু হলেও মোবাইল ইন্টারনেট ফিরেছে ২৮ জুলাই। তখন আনুষ্ঠানিকভাবে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন প্রক্সি সাইট ও ভিপিএন সেবার মাধ্যমে এই সাইটগুলোতে যেতে পারলেও বাংলাদেশের বেশ বড় একটি অংশের মানুষের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করাটা কঠিন ছিল। ৩০ জুলাই পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ফেসবুক বন্ধ রেখেছিল সরকার।

সন্দেহাতীতভাবে এই সময়টায় ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ভাটা পড়েছিল। গত ১০ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন-এই সীমার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় বাংলাদেশের সব মানুষ ফেসবুকের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারেনি, তবু এই সময়ে মেটার অ্যাড লাইব্রেরি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৬৩ হাজার ৮৭৩ ডলার খরচ করা হয়েছে বিজ্ঞাপনে। এর বাইরে ‘আননোন’ জায়গা থেকেও কিছু বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, তবে সে খরচটা ১০০ ডলারের কম।

এই ‘অজ্ঞাতস্থানের’ অংশটা বাদ দিলেও আজকের মূল্যমানে গত ১০ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট বাংলাদেশের ফেসবুকের বাজারে ৭৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি বিজ্ঞাপনে ব্যয় করা হয়েছে। ন্যূনতম একটি হলেও বিজ্ঞাপন দিয়েছে, এমন পেজের সংখ্যা ৮৯৮টি।

এর মধ্যে সিংহভাগ ব্যয় কয়েকটি পেজ থেকেই করা হয়েছে। মোট ৬৪টি পেজ ন্যূনতম ১০০ ডলার ব্যয় করেছে এই সময়ে। মজার ব্যাপার, এই ৬৪টি পেজের মধ্যে ৪৫টি পেজই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হয় পেজগুলো আনপাবলিশ করা হয়েছে বা ডিলিট করা হয়েছে।

বাংলাদেশি রাজনৈতিক বার্তা প্রচারে ফেসবুক বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করাটা নতুন নয়। ছবি: ফ্রি পিকের সৌজন্যে

এই সময়ে বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে ‘ভালোর পথে’ নামে একটি পেজ। ১০ জুলাই থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ১১ হাজার ১১৪ ডলার খরচ করা পেজটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ খরচ করা পেজ ‘আহ্বান’ ও ‘প্রেস এক্সপ্রেস’-এরও একই অবস্থা।

শুধু এই তিনটি পেজই নয়, বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা ১১টি পেজই এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বিজ্ঞাপন ব্যয়ে দ্বাদশ অবস্থানে থাকা ইউনিসেফ-ই প্রথম পেজ, যাদের সচল পাওয়া যাচ্ছে। এই আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সময়ে ৫টি বিজ্ঞাপনে ১ হাজার ৩৬ ডলার ব্যয় করেছে।

ব্যয়ের দিক থেকে ১৪তম অবস্থানে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফেসবুকে ৯১৩ ডলার ব্যয় করেছেন তিনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টায় ৭২৯ ডলার ব্যয় করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা ২০টি পেজের মধ্যে বর্তমানে ১৬টি পেজ আর অ্যাকটিভ নয়। ইউনিসেফ, তারেক রহমান, আওয়ামী লীগের পেজ ছাড়া শুধু আর একটি পেজই টিকে আছে, সেটি একটি বিদেশি আইটি প্রতিষ্ঠান।

সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের হিসাব থেকে যদি সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দেওয়া হিসাব দেখা হয়, সেখানেও একই চিত্র। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ২২০টি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল অধুনালুপ্ত পেজ- ‘ভালোর পথে’। ২১৯টি বিজ্ঞাপন দিয়ে দুইয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া পেজ- ‘আহ্বান’। এখনো টিকে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল পেজ দিয়েছে ২০৯টি বিজ্ঞাপন।

সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দেওয়া ২০টি পেজের মধ্যে আর শুধু দুটি পেজ এখনো টিকে আছে। এর মধ্যে একটি পাঞ্জেরি প্রকাশনী, অন্যটি বিএনপিপন্থী এক রাজনৈতিক কর্মীর পেজ।

অধিকাংশ পেজের এতটা ব্যয় করে এখন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ বোঝা খুব একটা কঠিন না। অনেক পেজের নামেই তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বোঝা যায়। আওয়ামী সরকারের মুখপাত্র হয়ে কন্টেন্ট সৃষ্টি করা এই পেজগুলো আপাতত নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়েছে।

শুধু অপরিচিত পেজই এটা করেছে, এমন নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা ব্যক্তিদের একজন ছিলেন সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। গত মাসেও ফেসবুকে ৩১৩ ডলার বিজ্ঞাপন দেওয়া এই রাজনীতিবিদের পেজটিও এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। নেই সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ নামের একটি পেজও।

ব্যয়ের দিক থেকে এগিয়ে থাকা ১০০টি পেজের মধ্যে ৪১টি পেজ এখনো টিকে আছে। এ সময়েও কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, তাদের পেজ বন্ধ হওয়ার কারণ নেই কোনো। কিছু পেজ বিরোধী দলের পক্ষে প্রচার চালিয়েছে, তারাও এখনো সগৌরবে টিকে আছে। আর বিগত সরকারের হয়ে প্রচার চালানো এবং আন্দোলনের সময় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া পেজগুলো আপাতত হারিয়ে গেছে।

তবে এর মাঝে বেশ কিছু পেজের ক্ষেত্রে অতীতের বিভিন্ন পোস্ট ও কন্টেন্ট ঘেঁটে বুঝতে হয়েছে যে, তারা বিগত সরকারের হয়ে প্রচার চালাচ্ছিলেন বলেই পেজগুলোর এখন এভাবে হারিয়ে যাওয়া। এদের মধ্যে ‘ইসলামের আলো’, ‘দুষ্ট কোকিল’, ‘দুশমন’, ‘মোনাজাত’, ‘এলিয়েন’- এই নামগুলো উল্লেখযোগ্য।

এদিকে ৮ আগস্টের পর বাংলাদেশে ফেসবুক বিজ্ঞাপনে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তারেক রহমান। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই সময়ে একটি বিজ্ঞাপনেই ২৫১ ডলার ব্যয় করেছেন। বিএনপির অফিশিয়াল পেজ ও মিডিয়া সেলের দুটি পেজ থেকেও ১০০ ডলারের বেশি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments
scroll to top