Close

২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি ॥ দাসত্ব বা গোলামির নয়ঃ জাফর ওয়াজেদ

২৫ বছরের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্র চুক্তির বিষয়ের গভীরে না গিয়ে বাস্তবতা বিবর্জিতভাবে এই চুক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরাজিত শক্তি যেমন ছিল সোচ্চার, তেমনি স্বাধীনতার সমর্থক কোন কোন দল নিন্দা-মন্দ প্রচারণায় ছিল সক্রিয়। যারা এই চুক্তির বিরুদ্ধে গলা হাঁকিয়েছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে এই চুক্তি বাতিল করেনি। ক্ষমতাকালে এ সম্পর্কে ‘টু’ শব্দটিও উচ্চারণ করেনি। অথচ সময় বাস্তবতায় এই চুক্তি ছিল বাংলাদেশের বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে বর্মফলকসম।

মেরুদ- সোজা করে বিশ্বসভায় নিজের অবস্থান তৈরি ও আসন পাতার লগ্নগুলো কোন সহজতর কাজ ছিল না বাংলাদেশের জন্য একাত্তর পরবর্তীকালে। সে ছিল এক বড় বন্ধুর পথ। পথে পথে নানা প্রতিবন্ধকতা। দেশী-বিদেশী হায়েনার ‘হা’ হয়নি বন্ধ তখনও। গোগ্রাসে গিলে খাওয়ার জন্য তখনও প্রস্তুত যেন তারা। প্রতিবেশী ছাড়া তখন তার পাশে বাস্তবে তেমন কেউ ছিল না। সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসার লক্ষণও ছিল না তেমন। অথচ নিজের স্বাধীন সত্তা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজন বিশ্বসভার স্বীকৃতি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসরদের ধ্বংসযজ্ঞ সারাদেশে। সে এক করুণ এবং নির্মম অবস্থা। সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান বাঙালীর জীবনে তখন দুর্ভোগের অন্ত নেই। দেশকে আবার স্বাভাবিক পথে নিয়ে আসা, কোটি কোটি নিরন্ন মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়াই তখন মুখ্য বাংলাদেশের জন্য। কোথাও কোন কিছুর মজুদ নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা সর্বত্র বিপর্যস্ত। অভ্যন্তরীণ এই করুণ দশার পাশে সংশয় শঙ্কা ছিল পরাশক্তির আস্ফালন, হুমকি আর পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্র। ত্রিশঙ্কু এক অবস্থান থেকে উত্তরণে সচেষ্ট তখন বাংলাদেশ। দেশের পার্বত্যাঞ্চলে তখনও পরাজিত শক্তি ঘাঁটি গেড়ে সশস্ত্র অবস্থানে। দেশের অভ্যন্তরে সর্বত্র অস্ত্রের ছড়াছড়ি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাও তখন অস্ত্রধারী। আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব তখনও পাকিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশের উত্থানের বিপরীতে অবস্থান করছে সশস্ত্র শক্তি নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া- এই তিন পরাশক্তির দাপট তখন বিশ্বজুড়ে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ছিলেন পাকিস্তানের শক্ত সমর্থক। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে লেখা এক চিঠিতে পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ এবং ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব’ রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান। সৌদি বাদশা তখন বলিষ্ঠভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছেন। তাকে অনুসরণ করেছে মধ্যপ্রাচ্যর অন্য দেশগুলো। শীতলযুদ্ধের যুগে তারা তখনও নবজাতক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। অনন্য নজির সৃষ্টি করে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বিজয়ের তিন মাসের মাথায় বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত তখনও ছিল অব্যাহত। এরই মধ্যে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর ও গণবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। বঙ্গবন্ধু অস্ত্র জমা নিতে বললেও এখানে-ওখানে অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার চলতে থাকে।

যুদ্ধকাল হতেই পার্বত্যাঞ্চলে দুর্বৃত্তরা অস্ত্র ব্যবহার করে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পরও পরাজিত শক্তি ও তাদের সহযোগীরা সেখানে আশ্রয় নেয়। তাদের সমর্থক তখন ভারতীয় নাগা জঙ্গীরা। এই অবস্থায় তাদের দমন করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে তলব করা হয়েছিল এই চুক্তির আওতায়। ওই চুক্তি তখন বাংলাদেশ-ভারতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থেই অতীব গুরুত্ববহ ও প্রয়োজনীয়। ওই চুক্তিই ছিল সেই দিনগুলোতে বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য রক্ষাকবচস্বরূপ। বিশ্ব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ-ভারত এই চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল, যা ছিল একাত্তরের যুদ্ধকালীন ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিরই অনুরূপ।

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী স্ব-স্ব দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি পঁচিশ বছর মেয়াদী শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রী চুক্তি সই করেন। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সই হয়েছিল ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। চুক্তির সমূহ গুরুত্ব ছিল এর নবম ধারায়। যাতে বলা হয়, দুই দেশের কারও বিরুদ্ধে যদি বহিরাক্রমণের বিপদ দেখা দেয়, তবে এই বিপদ অপসারণের জন্য উভয় দেশ অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে মার্কিন ও চীনের হুমকি মোকাবেলায় ভারত-সোভিয়েত এই চুক্তি করা হয়েছিল। এই চুক্তিকে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন- ‘বারুদের স্তূপে একটি জ্বলন্ত শলাকা নিক্ষেপ’। বলা যায়, এই চুক্তির আলোকেই স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রক্ষাকবচের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিটি সই হয়। এই চুক্তিটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে শর্ত থাকার কারণে। চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোন দেশ অপর দেশের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক জোটে যোগ দিতে পারবে না। এছাড়া অপর দেশের বিরুদ্ধে কোন রকম সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না। তার সীমানাধীন স্থল, জল এবং আকাশ অপর রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষতি অথবা অপর রাষ্ট্রের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবে না।

অপরদিকে অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত হয়েছে, উভয়পক্ষই অন্যপক্ষের বিপক্ষে কোন তৃতীয়পক্ষকে যে কোন সামরিক সংঘর্ষে কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না। যদি কোন পক্ষ আক্রমণের শিকার হয়, কিংবা আগ্রাসনের বা হুমকির মুখাপেক্ষী হয়, তবে অনতিবিলম্বে দুই পক্ষই পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই আক্রমণ কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মোকাবেলার জন্য। এভাবেই দু’দেশের শান্তি ও সংহতি বজায় রাখা হবে।

অনুচ্ছেদ ১০-এ বলা হয়েছে, ‘এই চুক্তির পরিপন্থী কোন অঙ্গীকার কোন পক্ষই অন্য কোন দেশ বা একাধিক দেশের সঙ্গে খোলাভাবে কিংবা গোপনে করতে পারবে না।’ বহির্শত্রুর আক্রমণ বা হুমকির মুখে একসঙ্গে যুদ্ধ করা দুটি প্রতিবেশী দেশকে আত্মরক্ষার জন্য এই পথ বেছে নিতে হয়েছে। যা ভারত-সোভিয়েত চুক্তিতেও রয়েছে। এই চুক্তিটি প্রধানত মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও ভারতবিরোধীদের দ্বারা কঠোর ভাষায় সমালোচিত হয়েছে। এটিকে গোড়াতে ‘অসম চুক্তি’ হিসেবে নিন্দা করা হয়েছে। তবে ১৯ মার্চের চুক্তির তিন দিনের মাথায় মওলানা ভাসানী এই চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু প্রমাণ করেছে; আমি এ কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।’ কিন্তু এই চুক্তির বিরুদ্ধে ভাসানীর অবস্থান নিতেও বেশি দিন লাগেনি।

ভাসানীসহ মাওবাদী উগ্র বামপন্থী নামধারী রাজনৈতিক দল, গ্রুপ ও গুপ্ত সংগঠন এবং পাকিস্তানী দালাল, পরাজিত শক্তি এই চুক্তিকে ‘সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার চুক্তি’ বলে উল্লেখ করতে থাকে। তারা এটাকে গোলামির চুক্তি, দাসত্বের চুক্তি, দেশ বিক্রির চুক্তি ইত্যাদি নানা মন্তব্য করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালায়। পাকিস্তানের পরাজয় যারা মেনে নিতে পারেনি, তারাই তখন চুক্তির বিরুদ্ধে প্রোপাগা-া চালাতে থাকে। এমনকি বাংলাদেশকে ‘ভারতের আশ্রিত রাজ্য,’ ‘করদ রাজ্য’- এসব পর্যন্ত বলতে থাকে। তথাকথিত বামপন্থীদের কয়েকটি পত্রিকা ভারতবিরোধিতার আবরণে পাকিস্তানের সমর্থনমূলক লেখালেখি প্রকাশ করতে থাকে। এর মধ্যে ভাসানীর হক কথা, প্রাচ্যবার্তা, মোহাম্মদ তোয়াহার গণশক্তি, অলি আহাদের ইত্তেহাদ, এনায়েত উল্লাহ খানের হলিডে, চট্টগ্রামের লাল পতাকা এবং স্পোকসম্যান ইত্যাদি পত্রিকায় অপপ্রচারের মাত্রা এত ছাড়িয়ে যায় যে, তারা পাকিস্তানের পক্ষালম্বন শুরু করে।

লন্ডন থেকে গোলাম আযমের তত্ত্ব¡াবধানে প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা এই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের কথিত ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালাতে থাকে। জাসদের গণকণ্ঠ ‘সরকারকে ভারতের তাঁবেদার’ সরকার বলে প্রচার চালায়। এমনকি সভা-সমাবেশে ‘পুতুল সরকার’ও বলা হতো। ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিটি পাকিস্তান, চীন, মার্কিন আগ্রাসনবিরোধী বলেই তাদের ক্ষোভ তীব্র ছিল। চুক্তিটিকে ‘গোলামির চুক্তির’ অভিধা দিয়ে রুশ-ভারতবিরোধী সেøাগান চালু করে। পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে একে গোলামির চুক্তি হিসেবে অভিহিত করলেও চুক্তিটিকে জনসমক্ষে প্রচার যেমন করেনি, বাতিলও করেনি। এই চুক্তিকে উপলক্ষ করে জিয়া, এরশাদ এবং পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণায় মুখর ছিল। তারা রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করলেও, চুক্তিটি বাতিলের পথে কেন যায়নি, সে প্রশ্নের জবাব মেলে না।

জিয়া নিজে এবং সরকার ও তার দলের নীতি-নির্ধারকরা সুযোগ পেলেই মৈত্রী চুক্তিকে সব সময় আখ্যায়িত করত গোলামির চুক্তি হিসেবে। বলা হতো, ‘এই চুক্তির ফলে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেছেন।’ কিন্তু জিয়া ক্ষমতা দখল করে কখনও এই চুক্তি বাতিল করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন এমনটি দেখা যায়নি। যদিও এই চুক্তির শর্ত মতে, ‘যে কোন একটি পক্ষ এই চুক্তি বাতিল করার ক্ষমতা রাখে।’ ১৯৯১ সালে, এমনকি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়াও একই পন্থা অবলম্বন করেন। এই চুক্তি বাতিল কিংবা গোপন শর্তাবলী প্রকাশ না করার একটাই কারণ, বাংলাদেশকে আশ্রিত রাজ্যের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়ার অভিযোগ নির্লজ্জ মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা লোটা ও পাকিস্তানী চেতনাকে প্রসারিত করার কাজটিই তারা করেছে। চুক্তি বাতিল না করাই প্রমাণ করে- এটি গোলামি বা দাসত্বের চুক্তি ছিল না।

চুক্তির শর্তাবলী স্পষ্ট করে- এতে সমতাভিত্তিক সম্পর্কই প্রাধান্য পেয়েছে। চুক্তিটির প্রয়োগ না হলেও আলোচনায় থেকেছে। ১৯৯৭ সালের ১৮ মার্চ স্বাভাবিকভাবেই মৈত্রী চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। চুক্তিটি পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়, এটি কোন গোলামি বা দাসত্বের নয়। বরং দুটি ঘনিষ্ঠ দেশের দৃঢ় অবস্থানকেই ব্যক্ত করে। মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তির প্রস্তাবনাই স্পষ্ট করে এই চুক্তির যথার্থতা। দুটি দেশের আদর্শ, নিরাপত্তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা, মৈত্রী, বন্ধুত্বকে দৃঢ় করা এবং তা সমগ্র এশিয়ায় সম্প্রসারিত করাই ছিল লক্ষ্য। বৈরিতা ও সংঘাতের পথ পরিহার করে স্বাধীন সত্তা নিয়ে সমস্যা সমাধান করার অঙ্গীকারও রয়েছে। কোথাও গোলামির গন্ধও মেলে না।

১২টি অনুচ্ছেদের চুক্তিনামায় দুটি দেশ যে স্ব-স্ব মর্যাদায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠা, তারই নিদর্শন মেলে। প্রথম অনুচ্ছেদেই পরিষ্কার হয় চুক্তির সারবত্তা। বলা হয়েছে, ‘চুক্তি সম্পাদনকারী উভয়পক্ষ স্ব-স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্য একযোগে সংগ্রাম এবং স্বার্থ ত্যাগ করেছেন, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছে যে, উভয় দেশ এবং তথাকার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও মৈত্রী বজায় থাকবে। একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে অবিচল থাকবে।

উভয়পক্ষ উল্লিখিত নীতিমালা এবং সমতা ও পারস্পরিক উপকারিতার নীতিসমূহের ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসুলভ সার্বিক সহযোগিতা ও সম্পর্কের উন্নয়ন আরও জোরদার করবে। এখানে পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে, কেউ কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তার অর্থ দুটি রাষ্ট্র যার যার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে শান্তিতে বসবাস করবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসুলভ সকল প্রকার সহযোগিতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব না থাকলে সার্বিক উন্নয়ন সুকঠিন। তাই দু’দেশ শান্তি ও মৈত্রী বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। প্রথম অনুচ্ছেদের কোথাও ‘গোলামির’ চিহ্ন মেলে না।

চুক্তির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে রয়েছে আন্তর্জাতিকতার প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে, ‘জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি সমতার নীতিতে আস্থাশীল থাকার আদর্শে পরিচালিত হয়ে উভয়পক্ষ সর্বপ্রকারের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের নিন্দা করছে এবং তাকে চূড়ান্তভাবে ও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর ব্যাপারে তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা পুনরুল্লেখ করছে। উভয়পক্ষ উপরোক্ত অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবিরোধী এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দান করবে।’ এখানে কোথাও গোলামির নিদর্শন মেলে না। মুক্তিকামী মানুষের প্রতি অবিচল থাকার অঙ্গীকারই বরং মেলে।

যেখানে দেখা যায়, উভয় রাষ্ট্রই সে সময় থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়ে আসছে। সে সময়ের বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে তৃতীয় অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশিত হয়। সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের বিশ্ব মানচিত্রের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াটা জরুরী ছিল। দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের শিকার তখন বাংলাদেশ এবং ভারতও। জোটনিরপেক্ষ থাকার প্রতি অবিচল দু’দেশ। এই অনুচ্ছেদেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয়পক্ষ বিশ্বের উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা মজবুত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জোটনিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাদের অবিচল আস্থার পুনরুল্লেখ আছে।’

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটি তখন গুরুত্ববহ ছিল। মার্কিন, চীন, পাকিস্তানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপের দেশগুলোরও স্বীকৃতি মেলেনি তখন। পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত। তারা তখনও কনফেডারেশনের স্বপ্নে বিভোর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালীদের ফিরিয়ে আনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া যুদ্ধবন্দী ৯৩ হাজার সেনা পাকিস্তানে ফেরত নিতে নানা কূটকৌশলের পথ নিতে হয়েছিল।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তখন বিশ্বসভায় দাঁড়াতে চায়। পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বৈদেশিক সাহায্যেরও প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিত্র তখন ভারত ও রাশিয়া। চতুর্থ অনুচ্ছেদে উল্লেখ পাওয়া যায়- ‘উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয় সকল স্তরে বৈঠক ও মত বিনিময়ের জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে।’

বাংলাদেশ তখন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদনও করেছে। কিন্তু চীন বার বার ভেটো প্রদান করতে থাকে পাকিস্তানের কুপরামর্শে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারতকে তখন নানা চাপের সম্মুখীন হতে হয়। যুদ্ধবন্দীদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘ পর্যন্ত চাপ প্রয়োগ করে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে আটকে পড়া ৪ লাখ বাঙালীকে ফেরত চায়। কিন্তু ভুট্টো বাঙালীদের প্রায় জিম্মি করে রাখে। যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানী সেনাদের ফেরত না দিলে বাঙালীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকিও দেয়। সে সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বাংলাদেশ-ভারত পারস্পরিক মতবিনিময় করার বিধান রাখা হয়েছে। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে ছাড়া তেমন স্বীকৃতি মিলছিল না তখন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ এবং যুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থাও অনেকটা নাজুক হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম ফ্রন্টেও তাকে লড়াই করতে হয়েছিল। এই অবস্থায় দুটি দেশের সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি সামনে আসে। ৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, ‘উভয়পক্ষ অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধা ও সর্বাত্মক সহযোগিতা শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করে যাবে। উভয় দেশ সমতা, পারস্পরিক সুবিধা এবং সর্বোচ্চ আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য নীতির ভিত্তিতে বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারিত করবে।’

চুক্তির এ অংশে দু’পক্ষেরই মর্যাদার সঙ্গে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার কথা রয়েছে। এখানে আনুগত্য বা দাসত্বের বালুকণাও মিলবে না। দু’দেশের মধ্যে প্রবহমান নদী, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুত বিষয়ে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে রক্ষায় নদীর উন্নয়ন ও সেচ সুবিধার বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উভয়পক্ষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুত শক্তি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে অভিন্ন মত পোষণ করে।’ এখানে গোলামির বিন্দু বিসর্গও পাওয়া যায় না। বরং উভয়পক্ষ পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাতই বাড়িয়েছে।

চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছরের জন্য উল্লেখ করে ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উভয়পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। আর চুক্তিটি কার্যকর হবে চুক্তি সইয়ের দিন হতে।’ কোন পক্ষই আর মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় আনেনি। এমনকি বাতিলও করেনি। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় স্বাক্ষরিত চুক্তিতে সর্বশেষ অনুচ্ছেদে বরং উভয়ের সম্মানজনক অবস্থানকে বিধৃত করেছে। শেষ অনুচ্ছেদ ১২ তে বলা হয়েছে, ‘এই চুক্তির কোন এক বা একাধিক অনুচ্ছেদের বাস্তব অর্থ নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোন মতপার্থক্য দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।’

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর এই চুক্তি নিয়ে প্রচারে যে নর্তন কুর্দন করা হয়েছিল, তা এখন ভাবলে শিহরিত ও বিস্মিত হতে হয়। চুক্তির বিরুদ্ধে যারা মুখে ফেনা তুলেছে, তারাই এই চুক্তি বহাল রেখেই দেশের শাসনকর্তা ছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলেও বেগম জিয়া প্রকাশ্যে বলা শুরু করেন, এখন সেই গোলামি চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। যদিও ৯৭ সালের ১৯ মার্চ তা বিলোপ হয়ে যায়। এই চুক্তি নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায় না গত দু’দশকের বেশি সময়ে।

লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত, মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ।

২৬ জুন ২০২০ প্রকাশিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments
scroll to top