Close

ন্যাটোর দিকে ঝুঁকছে জাপান

nato

জাপান বহুপক্ষীয় কোনো সামরিক জোটে নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা চুক্তি আছে। দ্বিপক্ষীয় ওই চুক্তি অনুযায়ী, একটি দেশ শত্রুর হামলার শিকার হলে তা প্রতিহত করতে অন্য দেশ এগিয়ে আসবে। তবে সে ক্ষেত্রেও সাংবিধানিক কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ কারণে জাপানের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো সম্ভব না।

জাপানের সংবিধানের বিশেষ একটি ধারা দেশটিকে যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রেখেছে। একই ধারায় কোনো সামরিক জোটে দেশটির যোগ দেওয়ার ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও জাপানের দক্ষিণপন্থী বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দেশটিকে সামরিক জোটের সদস্য বানাতে আগ্রহী। এ লক্ষ্য অর্জনে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে তারা।

২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের পর জাপানকে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে তোলা জোটে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন টোকিও কিছুটা বিপাকে পড়লেও সংবিধান পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটি উপায় দেশটির নেতারা ঠিকই খুঁজে বের করেছিলেন।
দেশের বাইরে সেনা পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিদেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলেও জাপানের ক্ষমতাসীন মহল বিভিন্ন সময়ে সংবিধানের নানা ফাঁক খুঁজে সেই পথে ঠিকই অগ্রসর হয়েছিল।

একইভাবে সংবিধানগত বিধিনিষেধের কারণে নিয়মিত সেনাবাহিনী রাখা জাপানের পক্ষে সম্ভব না। এরপরও গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে আত্মরক্ষা বাহিনী নাম দিয়ে কার্যত যে সামরিক বাহিনী জাপান গড়ে তুলেছিল, সেই বাহিনী এখন সমরাস্ত্র, জনবল ও প্রতিরক্ষা খাতে খরচের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি সমরশক্তির বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এ কারণে জাপানের রাজনীতিবিদদের ভালোভাবেই জানা আছে যে বাহ্যিকভাবে নিষিদ্ধ থাকা কিংবা সংবিধানে অলঙ্ঘনীয় হিসেবে গণ্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কীভাবে পার হওয়া যায়। ঠিক সেই রকম একটি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা সম্প্রতি এসেছে জাপান সরকারের কিছু সূত্র থেকে।

আজ শনিবার জাপানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা চলতি মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ন্যাটো সামরিক জোটের শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে স্পেন ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন। এটা হবে জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রীর প্রথমবারের মতো ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেওয়া।
নোবুসুকে কিশি, ইয়াসুহিরো নাকাসোনে কিংবা শিনজো আবের মতো জাপানের আগের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যেও কেউই কিন্তু এই পথে এগোননি। বিশেষ করে আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে ‘শান্তির জাপান’ ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়টি মাথায় রেখে এ পদক্ষেপ নেওয়া থেকে তাঁরা বিরত ছিলেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ফুমিও কিশিদা কেন আগ বাড়িয়ে সেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন?

ন্যাটো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য আগ্রাসন ঠেকাতে সমমনা দেশগুলো এই সামরিক জোটটি গঠন করেছিল। এর জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে গড়ে তোলে ওয়ারস জোট।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া ওয়ারস জোটের অস্তিত্বের ইতি টানলেও ন্যাটো কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি, বরং আরও বেশি শক্তিশালী ও বিস্তৃত হয়েছে। ওয়ারস জোটের বিলুপ্তির ৩০ বছর পর ন্যাটো এখন এক অর্থে হয়ে উঠেছে বিশ্বের মোড়ল, যদিও সেই মোড়লকে নিয়ন্ত্রণ করার রজ্জু ধরা আছে ওয়াশিংটনের হাতে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান পশ্চিমের মিত্রদের কাছে ন্যাটোকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। বিশেষত, ইউরোপের ছোট ও দুর্বল দেশগুলো মনে করছে, ন্যাটোর সহায়তা ছাড়া তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। সেই ধারণা কতটা যৌক্তিক, তা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। তারপরও পশ্চিমের অনেক দেশ ন্যাটোকেই এখন তাদের শেষ ভরসা হিসেবে ধরে নিচ্ছে।

অন্যদিকে জাপানের সামনে সেই অর্থে এ মুহূর্তে বড় ধরনের সমস্যা দেখা না দিলেও অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে চীনের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা দেশটিকে অস্বস্তিতে ফেলছে। পূর্ব চীন সাগরের জনমানবহীন ক্ষুদ্র কয়েকটি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে জাপান ও চীন অনেকটা রাখঢাক ছাড়াই বিবাদে জড়িয়েছে। জাপান দ্বীপগুলো নিয়ন্ত্রণ করলেও চীন বলছে সেগুলোর মালিকানা বেইজিংয়ের। ফলে সীমিতভাবে হলেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে।

অন্যদিকে তাইওয়ান পরিস্থিতিও হঠাৎ করে ঘোলাটে হয়ে উঠতে শুরু করেছে। মার্কিন নেতৃত্ব এখন বলতে শুরু করেছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর তাইওয়ান নিয়েও একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রেরণা পাচ্ছে চীন। তাইওয়ানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা করা ওয়াশিংটনের পবিত্র দায়িত্ব। গত মাসে জাপান সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই ঘোষণা দিয়েছেন। জাপানের নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সেই অবস্থানের সঙ্গে একমত।

তবে নীতিগত অবস্থানের দিক থেকে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশই কিন্তু তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবেই ধরে আসছে। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও এর এক বছর পর জাপান চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এ সময় দুই দেশই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ানকে দেওয়া তাদের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়।

এখন দুই দেশের উল্টো পথে হাঁটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা হয়তো চীনকে সামরিকভাবে মোকাবিলার একটি সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। আর এমন অবস্থা দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সমমনা অন্য দেশগুলোকে পাশে পেতে চাচ্ছে জাপান।

সেদিক থেকে ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারলে পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ রণাঙ্গনে ইউরোপীয় মিত্রদের জড়িত করা জাপানের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে। ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে যোগদানে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।

তবে জাপানের বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোয় ন্যাটোয় যোগদানের সুযোগ নেই। ফলে ধারণা করা যায়, হয়তো বিকল্প কোনো উপায় জাপানের নেতারা খুঁজছেন। আবার সরাসরি সদস্য দেওয়ার দিকে না এগিয়ে, ন্যাটোর সঙ্গে জাপানকে জড়ানোর অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাঙ্ক্ষিত হবে।

ওয়াশিংটন জাপানকে বরাবরই দেখে এসেছে অনেকটা দুধেল গাভির মতো। ফলে সে রকম একটি ব্যবস্থার আওতায় চীনের ভয় দেখিয়ে ন্যাটোর আর্থিক ব্যয়ের বড় একটি অংশ বহনের ভার জাপানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে।

এদিকে বিগত বছরগুলোয় জাপানের প্রতি সামরিক ব্যয় বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাপান প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ালে লাভবান হবে ওয়াশিংটন। কারণ, জাপানের সমরাস্ত্রের প্রায় সবটাই আমদানি হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তাই জাপানের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির অর্থ হবে মার্কিন সামরিক শিল্পের জন্য অস্ত্র বিক্রির সুযোগ আরও বেড়ে যাওয়া।

জাপান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট বৃদ্ধির আহ্বানে অনেক দিন ধরে সাড়া দেয়নি। তবে টোকিও এখন বলছে, আগামী পাঁচ বছরে দেশের সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে উন্নত করা হবে। এর ফলে প্রতিরক্ষা বাজেট কতটা বাড়বে, তার একটি আভাসও পাওয়া গেছে এ নিয়ে ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দলের করা সুপারিশ থেকে।
দলটি চাইছে, আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় যেন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। দেশের বর্তমান প্রতিরক্ষা ব্যয় হচ্ছে জিডিপির ১ শতাংশের সামান্য কম।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানের জিডিপি বিশাল। শতাংশের হিসাবে তা কম মনে হলেও ১ শতাংশ ধরে নিয়ে ২০২২ অর্থবছরে যে বাজেট বরাদ্দ প্রতিরক্ষা খাতের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তার পরিমাণ ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি ইয়েন।

আগামী পাঁচ বছরে এটা দ্বিগুণ করতে হলে প্রতিবছর এক লাখ কোটি ইয়েনের বেশি খরচ জাপানকে করতে হবে। এই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ জাপান। ফলে ধারণা করা যায় যে আরও বেশি বন্ড বাজারে ছাড়ার মধ্য দিয়েই সেই অর্থ জাপানকে সংগ্রহ করতে হবে। অর্থাৎ ঋণের বোঝা আরও অনেকটা ভারী হয়ে উঠবে।
ন্যাটো সামরিক জোটের সঙ্গে জাপানের ঘনিষ্ঠতা এ রকম হিসাব–নিকাশের আওতার মধ্যেই পড়ে। ফলে পূর্ব এশিয়াজুড়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হওয়া এখন আর ধারণাগত একটি বিষয় নয়। বরং সেই প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং আগামী দিনগুলোতে তা আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments
scroll to top