বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরপরই তার তিন ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং একজন মন্ত্রী বিদেশে অবস্থানের সুযোগ পেয়েছিলেন।ঘাতক চক্রের নাগালের বাইরে ছিলেন তারা। এরা হলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. মোশাররফহোসেন ও ড. কামাল হোসেন।
এরা চার জন পরিচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্যাং অব ফোর। ড. কামাল হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।অপর তিন জন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা।
আমাদের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে আমি শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা করি অর্থনীতিতে তার পাণ্ডিত্যের জন্য। আরেকবাঙালি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, রেহমান সোবহান অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য পণ্ডিত।আমার ধারণা, এ ব্যাপারেও সবাই তার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনেও রেহমান সোবহানের কথাশ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু যখন তার ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন, তখন সেই ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদআখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের মিলিটারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকার নানা ধরনের অসত্য প্রচারণা শুরু করেছিল। এমনকিআওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতাও ৬ দফা সমর্থনে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তখন এই রেহমান সোবহানই অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ৬দফা সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদেরও তিনি ৬ দফার যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টাকরেছেন।
এই শ্রদ্ধেয় রেহমান সোবহান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি ৬ দফা দিবস স্মরণেআয়োজিত বিশেষ ওয়েবিনারে রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এটা তো অপ্রাসঙ্গিক কথা। কারণদেশ ইতিমধ্যে স্বাধীন হয়ে গেছে। একজন মাত্র লোক যোগ্য ছিলেন, যিনি সেই স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেবেন, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ রেহমান সোবহান ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে স্বীকার করলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধের নায়ক। অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষকও। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬দফা ঘোষণার পরই অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
রেহমান সোবহান আরো বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নামেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠিত হয়েছিল এবংআমিও বঙ্গবন্ধুর নামেই নয় মাস আন্তর্জাতিকভাবে আন্দোলন করেছি।
বর্তমানে এই কথাগুলো জনমত স্বীকৃত, ইতিহাস স্বীকৃত। সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ মানুষ কথাগুলো জানেএবং বিশ্বাস করে। তাহলে স্বাধীনতার ঘোষক এবং স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম জনসাধারণের মন এবংইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার জঘন্য চক্রান্ত হয়েছিল তখন জনগণকে একটা বিভ্রান্তি এবং ইতিহাসকে একটা বিকৃতি থেকেমুক্ত করার জন্য রেহমান সোবহানের মতো পণ্ডিত এবং ইতিহাসের সাক্ষী গত ৪৬ বছর ধরে মুখ খোলেননি কেন? যিনি স্বীকারকরছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নামে স্বাধীনতার যুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশ গ্রহণ করেছেন, সেই নেতা এবং তারসহকর্মীদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশের একজন বরেণ্য পণ্ডিত হয়ে তিনি এবং তার বন্ধু পণ্ডিতেরা ৪৬ বছর যাবৎ নীরবরইলেন কেন?
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরপরই তার তিন ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং একজন মন্ত্রী বিদেশে অবস্থানের সুযোগ পেয়েছিলেন।ঘাতক চক্রের নাগালের বাইরে ছিলেন তারা। এরা হলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. মোশাররফহোসেন ও ড. কামাল হোসেন। এরা চার জন পরিচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্যাং অব ফোর। ড. কামাল হোসেন ছিলেনবঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অপর তিন জন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর মনি সিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি জেনারেল জিয়ার খাল কাটার পরিকল্পনায় যোগদানকরে। চীনপন্থি বাম দল–উপদলগুলোর (মওলানা ভাসানী নীরব) সঙ্গে ভাসানী ন্যাপ ও জিয়াউর রহমানের সামরিক জান্তাকেসরাসরি সমর্থন দিচ্ছে তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলারকোনো নেতৃত্ব নেই। তখন সবারই চোখ গিয়েছিল অক্সফোর্ডের দিকে। সবাই আশা করেছিলেন বিদেশে বসে এই প্রতিরোধআন্দোলন নেতৃত্ব দেবেন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া নেতা এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। যার রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মানও প্রতিষ্ঠা। এই সংগ্রামে তার সঙ্গে থাকবেন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত যে তিন বুদ্ধিজীবীছিলেন সহযোদ্ধা, তারা তো প্রতিরোধ সংগ্রামে এগিয়ে আসবেনই।
দুর্ভাগ্যের কথা, কেউ আসেননি। এই সময় শোনা গেল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে মার্কিন সিআইএ। এই সিআইএয়ের অর্থে চালিতমার্কিন ফাউন্ডেশন অন্যান্য দেশের বুদ্ধিজীবীদের মতো বাংলাদেশের কয়েক বুদ্ধিজীবীকে অক্সফোর্ডে থাকার অর্থায়ন করছে।বাংলাদেশ কেন, কোনো দেশেরই প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেওয়া সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। গুজবটা কতটা সঠিক তা জানি না।কিন্তু আমাদের ‘গ্যাং অব ফোর’ লন্ডনে যখন গউস খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে, তখন তাতে নেতৃত্ব দেওয়া দূরের কথা একবার মুখটাও দেখাননি। বরং তাদের মধ্যে একজন জিয়া সরকারের সুপারিশে পাওয়াএক আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি পেয়ে তা লুফে নিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলে জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ড ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে গউস খানের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সংগ্রাম পরিষদলন্ডনের কনওয়ে হলে প্রতিবাদ সভা ডাকেন। এই সভায় তিন জন ব্রিটিশ এমপি যোগ দেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীমোশতাকের সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে কনওয়ে হলের প্রতিবাদ সভায় যোগ দেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন যোগদিতে প্রথমে রাজি হননি। ‘গ্যাং অব ফোরের বন্ধু এবং ‘মূলধারা ’৭১’ গ্রন্থের লেখক মইদুল হাসান অনেক ধরপাকড় করে ড. কামাল হোসেনকে কনওয়ে হলের জনসভায় নিয়ে আসেন। কিন্তু সভা চলাকালীন অবস্থায় তিনি সম্মেলন হলের পেছনেরদরোজা দিয়ে কাউক কিছু না বলে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় শাহাদতবার্ষিকী লন্ডনে পালনের আয়োজন করা হলে শেখ রেহানা (তখন লন্ডনে অবস্থান করছেন) অনুরোধজানালেন সভাটি তার বাসার কাছে কোনো হলে যেন করা হয়। তিনি জানালেন, এই মৃত্যুবার্ষিকীর সভায় অক্সফোর্ড থেকে তার‘বিগ আঙ্কেল’ ড. কামাল হোসেন এবং তার তিন বন্ধু যোগ দেবেন। সভার উদ্যোক্তারা এই চার ব্যক্তিত্বের আগমনের কথাজোরেশোরে প্রচার করলেন। কিন্তু সভা আরম্ভ হলে দেখা গেল, সভার এক কোণে কিসতি টুপি মাথায় ড. মোশাররফ হোসেনচুপচাপ বসে আছেন। তার বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বিরস মুখে বললেন, কামাল তো নিউ ইয়র্কে একটা জরুরিসভার ডাক পেয়ে চলে গেছেন।
সত্য কথা বলতে কি এই চার বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ড. মোশাররফ হোসেন লন্ডনে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গেযোগাযোগ রেখেছেন, রেহমান সোবহানও পরামর্শ জুগিয়েছেন মাঝে মাঝে। এছাড়া দেশে গণ–অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেতাদের আর কোনো ভূমিকা নেই। এই আন্দোলনের সামনে বড় এসিড টেস্ট ছিল, যখন জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতেই দেশেরসংবিধানের চরিত্র হত্যা এবং বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার মিথ্যাচার শুরু হয়, এ সময় স্বাধীনতার ঘোষক তত্ত্ব আবিষ্কৃতহয়। অঘোষিতভাবে শেখ মুজিবুর রহমান এই নামের আগে বঙ্গবন্ধু লেখা এবং বলা বন্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুই যে স্বাধীনতারঘোষক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক, তা অস্বীকার করা হয়। বলা হয় জিয়াউর রহমানের একটি বিতর্কিত বেতার ঘোষণাতেই দেশস্বাধীন হয়ে গেছে। দীর্ঘ একুশ বছর যাবত্ এই মিথ্যা জাতির নতুন প্রজন্মকে শেখানো হয়েছে।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এই মিথ্যা প্রচারের উপযুক্ত জবাব দেওয়া শুরু হয়। তার পরও স্বাধীনতার ঘোষকও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে। এক ভিলেনকে জাতির পিতার সমতুল্য নায়ক হিসেবেপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। এ সময় দরকার ছিল একটি ক্রেডিবল কণ্ঠস্বর, যিনি বা যারা জাতির নতুন প্রজন্মকে জানাবেনমুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কে তার প্রকৃত পরিচয়। জাতি তাদের কথা বিশ্বাস করত। স্বাধীনতার ঘোষক ওজাতির পিতা নিয়ে কুতর্ক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা তখনই বন্ধ হতো।
কিন্তু এত দীর্ঘকাল তারা নীরব রইলেন কেন? সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা কেন দিলেন সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট হতে? আরএই চার বুদ্ধিজীবী (একজন এখন প্রয়াত) জাতির নবপ্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও নায়ক সম্পর্কে কথা বলতে দীর্ঘ ৪০ বছরেরবেশি নীরব রইলেন কেন? আজ দেশ–বিদেশে মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হিসেবে জাতীয়জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত।
তখন রেহমান সোবহান বলছেন, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক অপ্রাসঙ্গিক। তিনিও বঙ্গবন্ধুর নামে এই নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধেআন্তর্জাতিকভাবে অংশ নিয়েছেন। এই সাদামাটা কথাটা বলতে তার চার দশক লাগল কেন? প্লিজ রেহমান সোবহান, জবাবদিন—কেন, কেন, কেন?
লন্ডন ১২ জুন, শনিবার, ২০২১
( প্রয়াত সাংবাদিক, কলামিষ্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি )
)