দুই যুগের গাঁটছড়া বিএনপি-জামায়াতের। মাঝেমধ্যে এ গাঁটছড়ায় টান পড়লেও ছিঁড়ে না। রাজনৈতিক নানা সমালোচনা মুখে বিগত ৬ বছর ধরে কৌশলগত দূরত্বে চলছে মিত্র এই দল দুটি। শেষ পর্যন্ত জামায়াত বিএনপির এই গাঁটছড়া ইতি টানার এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান।
দীর্ঘদিন ধরে টানাপড়েন চলছিল ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময় জামায়াত ছাড়ার কথা বললেও জামায়াতের পক্ষ থেকে কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। তবে সম্প্রতি এক সভায় ভার্চ্যুয়াল বক্তব্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান।
দুই যুগের জোটসঙ্গী। জোটে চড়ে এক দফায় স্বাদও পায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার। স্বাধীনতাবিরোধী দল হওয়ায় তাদের নিয়ে ‘রাজনৈতিক অস্বস্তিও’ নতুন নয়। এরপরও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়েই দীর্ঘকাল রাজনৈতিক পথ ভেঙেছে বিএনপি। হঠাৎ খবর আসছে, সেই জামায়াতই বিএনপি জোট ছাড়ছে!
জামায়াতে ইসলামীর বিএনপি জোট ছাড়ার খবরে নানান কানাঘুষা। তবে ‘স্পিকটি নট’জোটের প্রধান দল বিএনপির। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সময় মতো এই বিষয়ে কথা বলবেন। এদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি থেকে জামায়াতের আলাদা হওয়া তাদের রাজনৈতিক কৌশল।
বিএনপির নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে গড়া জোটে যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী। কেটে গেছে দুই যুগ। জোটের সঙ্গী হয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতার স্বাদ পায় দলটি।
তবে একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতায় থাকা দলটি এখন রাজনীতির পালাবদলে বেকায়দায়। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এই জামায়াতকে মূল্যায়ন না করার অভিযোগ এনে সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সভায় জোটে জামায়াত আর নেই বলে জানান দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তার সেই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ওই ভিডিওতে জামায়াত আমিরকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এতদিন একটা জোটে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন, কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি।’
জোটকে অকার্যকর উল্লেখ করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বছরের পর বছর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। তবে হ্যাঁ, জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপির সঙ্গে জোটের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমীর বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, এর সাথে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোন জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসকল ত্যাগ যেনো আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করে। যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে।’
এদিকে বিএনপি থেকে জামায়াতের আলাদা হওয়াকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন ‘আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত কখনো ছিন্ন হবে না। জামায়াতের আমির বলেছেন তারা যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে। এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল। একাত্তরে জামায়াত,পঁচাত্তরে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। এখনো তাদের উত্তরসূরীরা একই কাজ করছে। বিএনপি জামায়াতকে কখনো ছাড়তে পারবে না।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বলেছেন,‘বিএনপির বড় উইকেট পড়ে গেছে। জামায়াতে ইসলাম বলেছে বিএনপির সঙ্গে তারা আর নেই। তারা এখন শোকে কাতর।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘বিএনপিকে ছেড়ে জামায়াত চলে গেছে না জামায়াতকে ছেড়ে বিএনপি চলে গেছে, তা বোধগম্য নয়। আসলে রসুনের গোড়া এক জায়গায়ই হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওদের চরিত্র এক, ওদের লক্ষ্য এক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে তারা মুছে ফেলতে চায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করাই তাদের উদ্দেশ্যে এদের।’
তবে জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। তবে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সময়মতো জানাব। এ ব্যাপারে আমি কোনো কমেন্ট করব না।’
এদিকে ভাইরাল বক্তব্য সম্পর্কে জানতে জামায়াতে ইসলামীর আমির ও দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।