ব্যারিষ্টার বিপ্লব বড়ুয়া: “আপনার পিতা নিজের জীবনের মূল্যে বাংলাদেশকে জীবন দিয়েছে। নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতার বিনিময়ে এবং বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনি বাংলাদেশের জন্মাধিকার, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছেন”। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রদত্ত ‘ডক্টর অব ল’ ডিগ্রির সম্মাননা পত্রে কথাগুলো যৌথভাবে লিখেছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান, আর্ল সি কূলী এবং প্রেসিডেন্ট, জন অয়েস্টলিং। হন্তারকেরা জাতির জন্মদাতাকে কাপুরুষের মত হত্যা করে বাংলাদেশকে তাঁর জন্মাধিকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল যোজন যোজন দূরে। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসকেরা দেশ পরিচালনা করেছে একাত্তরের পরাজিত শক্তির আদর্শে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একে একে আমরা ফেরত পেয়েছি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই সঙ্গে পেয়েছি অর্থনৈতিক মুক্তি।
গ্রীক পূরাণের জগতখ্যাত ট্রয় যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এ্যাগামেমনন যুদ্ধ জয় করে দেশে ফিরে আসলে নিহত হন শত্রুর হাতে। এ্যাগামেমনন দুহিতা ইলেক্ট্রাসহ পরিবারের সকলে বিতাড়িত হন রাজ্য থেকে। আট বছর পর ইলেক্ট্রা ফিরে আসেন নিজ রাজ্য মাইসিনে, প্রতিশোধ নেন পিতৃহত্যার। এই ইলেক্ট্রাকে নিয়ে আমাদের কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা, “ইলেক্ট্রার গান”। কবিতায় কবি লিখেছেন, “গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধ্বসে/ বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,/ নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।/ নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।/ আড়ালে বিলাপ করি একা-একা, ক্ষতার্ত পিতা/ তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।/ এমন কি, হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি/ নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়!”
মহাকাব্যের চরিত্র ইলেন্ট্রার কান্না যেন হাজার হাজার বছর পরে জমা বাঁধল আমাদের দুঃখিনী শেখ হাসিনার বুকে। নিহত জনক-জননী, পরিজন – কবরে শায়িত আজ। তাঁর জন্যে বিলাপ করা, প্রকাশ্যে শোক করাও নিষিদ্ধ ছিল। নির্বাসনে, নিজের পরিচয় গোপন করে তিনি শরণার্থীর জীবন কাটিয়েছেন দীর্ঘ ছয়টি বছর। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ভেদ করে তিনি যখন দেশে ফিরে এলেন, তখনো তাঁকে জেনারেল জিয়া ঢুকতে দেয়নি আপন গৃহে। নিজের মানুষদের নিয়ে রাস্তায় বসে দোয়া করতে হয় ঘাতকের হাতে হারানো পিতা, মাতা, সহোদর, ছোট্ট রাসেল, দুই ভাত্রীবধু, চাচাসহ নিকট আত্মীয়দের জন্য। বাঙালি বলেছিল, হাসিনা তোমার ভয় নাই/ আমরা আছি লাখো ভাই। লাখো ভাই-বোনের, মুক্তিযুদ্ধের শহীদের আর নিজের পরিবারের রক্তে ভেজা প্রিয় বাংলাদেশের ভালোবাসা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বলেছিলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে, বাংলার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেবার জন্য”। তারপর একে একে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন বাঙালির হারিয়ে ফেলা সব জন্ম অধিকার – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন তিনি সবার আগে। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে জনমনে সাহস ফিরিয়ে দিয়ে, জনগণের ভালবাসা থেকে সাহস নিয়ে তিনি একে একে সরিয়েছেন সকল জঞ্জাল। ১৯৮০’র দশকে জনমত সৃষ্টি করে, গণজাগরণ তৈরি করে প্রথমেই ক্ষমতাচ্যুত করেছেন স্বৈরশাসক এরশাদকে। তারপরেও দেশি-বিদেশি চক্রান্তে আর কারচুপিতে হাতছাড়া হয়ে যায় ‘৯১-এর নির্বাচনের ফলাফল। এর পর ৯৪ সালের বহুল বিতর্কিত মাগুরা নির্বাচনে গণতন্ত্রের চরম অবমাননা দেখে আবারও ঘুরে দাঁড়ালেন সর্বংসহা শেখ হাসিনা। বারবার নিজের জীবনের উপর আসা আঘাতগুলোকে সামলে নিয়ে, গণতন্ত্রের জন্য জীবন বাজি রেখে জনগণকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন দুর্বার আন্দোলন। ১৯৯৬ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক আর দালালদের মুখপাত্র, স্বৈরাচার জেনারেল জিয়ার সহধর্মিনী, খালেদা জিয়াকে হটিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর তিনি যেন ভস্ম থেকে জ্বলে উঠলেন ফিনিক্স পাখির মত। আলোকিত করলেন বাংলাদেশকে। বাংলার মানুষকে দেখালেন আশার আলো। দেশবাসী ফিরে পেল ’৭৫-এ হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ফিরে পেল তার নিজের গতিপথ।
তখনো শেষ হয়নি তাঁর পাহাড়সম জঞ্জাল সরানোর কাজ। ৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি মোটা ভাত, মোটা কাপড়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বপরি জনকল্যাণে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। দেশকে প্রায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ করে ফেলেন অল্প কিছু সময়ের মধ্যে। একই সঙ্গে শুরু করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার। পাকিস্তানী আর সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাভাবনা থেকে একে একে সারিয়ে তুলতে থাকেন দেশকে। ফিরিয়ে দেন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করার প্রস্তাব। জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার অপরাধে দেশি-বিদেশি অপরাজনীতিকেরা আবারও রোধ করে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত এবং শেখ হাসিনার আরাধ্য – মুক্তির সংগ্রাম। শেখ হাসিনাই দেশের প্রথম সরকার প্রধান যিনি সাংবিধানিক পদ্ধতিতে, সঠিক সময়ে সরকারের দ্বায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ব্যাপক দুর্নীতি আর কারচুপির মাধ্যমে তাঁর দল আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়া হয় ২০০১ সালের নির্বাচনে। স্থগিত হয়ে যায় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম।
পাকিস্তানী আদর্শের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি খালেদা জিয়া ২০০১ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই শুরু করে পরবর্তী নির্বাচনকে ইঞ্জিনিয়ারিং করার অপকৌশল। এর ধারাবাহিকতায় নিজেদের পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধি; নিজেদের আজ্ঞাবহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে ভোটার লিস্টে ১ কোটি ২৩ লক্ষ ভুয়া ভোটার যুক্ত করাসহ নানাবিধ অপকর্ম। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির গণতন্ত্রবিরোধী এবং দুর্নীতিতে পরপর পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজাতে বঙ্গবন্ধুতনয়া আবারও গড়ে তোলেন গণ-আন্দোলন। জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে কেঁপে ওঠে খালেদা জিয়ার মসনদ। সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধু তনয়া দমন করে দেন স্বৈরাচার জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতির ভিত্তিমূল।
খালেদা জিয়াকে রাজনীতির মাঠে পরাস্ত করার পর আবারও ষড়যন্ত্র করে সাম্রাজ্যবাদীরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় সরকার পরিচালনার দ্বায়িত্ব তুলে দেয় অনির্বাচিত পুতুল ফখরুদ্দীন আহমেদের হাতে। শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের লড়াইটা শেষ হয় না। আবারও গণতন্ত্রের জন্য নামতে হয় বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে; যেতে হয় জেলখানায়। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের অনাচারে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে বেশুমার; মুদ্রাস্ফীতির পারদ উঠতে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে; জনজীবনে সৃষ্টি হয় অশান্তি। জন দাবীর মুখে তাঁকে আর জেলে আটকে রাখতে পারেনি সাম্রাজ্যবাদীদের পুতুল সরকার। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখের বেটি হুংকার দেন, “দেশে হচ্ছেটা কি?” এক হুঙ্কারে খান খান করে ভেঙ্গে পড়ে দেশ বিরোধীদের তাসের ঘর। বাধ্য হয় নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা করতে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রথমেই চালু করেন খালেদা জিয়ার সময়ে থামিয়ে রাখা বঙ্গবন্ধু হত্যার অসমাপ্ত বিচারের কাজ। এই নির্বাচনের প্রাক্বালে নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি ঘোষণা করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের অঙ্গীকার। সে মোতাবেক সংস্কার করেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইনকানুন। শুরু হয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার। যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার করতে গিয়ে তাঁকে আবারও সম্মুখীন হতে হয় দেশি-বিদেশি হাজার হাজার বাঁধা, বিপত্তির। চরম ধৈর্য্যের সঙ্গে সকল বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে সম্পন্ন হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার; কার্যকর করা হয় রায়। একে একে কার্যকর হতে থাকে কুখ্যাত সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়। একে একে বাংলাদেশ মুক্তি পেতে থাকে দীর্ঘকালের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে। বাংলাদেশে ফিরে আসে আইনের শাসন। সাম্রাজ্যবাদী আর তার দোসরদের সৃষ্ট গণতন্ত্র বিরোধী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দূর করতে বঙ্গবন্ধু দুহিতা সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশকে উপহার দেন নিরঙ্কুশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। একই সঙ্গে সংবিধানে ফিরিয়ে আনেন স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানে বাতিল করা সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপপেক্ষতা। পাহাড়সম বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে হিমালয় বিজয়ী বীরের মত ধাপে ধাপে তিনি ’৭৫-এ লাইনচ্যুত বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন নিজের পথে।
শেখ হাসিনা রাজনীতিতে অংশ নেবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি পরমানুবিজ্ঞানীর সঙ্গে পেতেছিলেন ঘর। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, তাঁকে নিয়ে এসেছে রাজনীতিতে। পিতার কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন মানুষকে ভালবাসতে আর বাংলাদেশের চার ভিত্তি – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ আর ধর্মিনিরপেক্ষতা। রাজনীতি করতে এসে তিনি পিতার আদর্শ আর সাধারণ মানুষের জন্য ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন প্রকৃত রাজনীতিবিদের পথে। জনকল্যাণের পথে। পথই তাঁকে পথ চিনিয়েছে। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তিনি লড়াই করেছেন গণতন্ত্রের জন্য। তাঁর শাসনামলে দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে হাজার হাজার অবিতর্কিত স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় নির্বাচন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্থ এবং দেশবিরোধী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের ভরাডুবি এবং পরবর্তী সময়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় জনমনে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির স্বরূপ স্পষ্ট করে তুলে ধরে যার ফলে জনগণ ছুঁড়ে ফেলে দেয় জামায়াত-বিএনপি কুচক্রকে। জনভিত্তি হারিয়ে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পায়। নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হতে না পারে তার জন্য তারা মানুষ পুড়িয়ে, নির্বাচনী কেন্দ্র জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে বিতাড়িত হয়েছে রাজনীতির মাঠ থেকে। গণতন্ত্রের জন্য যাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন সেই গণতন্ত্র বিরোধীরা আজ গণতন্ত্র শেখায়।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর শুধু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে তুলেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পুর্ণ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতেও এনেছেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাঁরই হাতে গ্রাম পর্যায়ে চলে গেছে চিকিৎসা সেবা; বাংলাদেশ আজ ডিজিটালাইসড; মাত্র তিন দশক আগের গরুর গাড়িতে চড়া বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এখন মহাশূন্যে; ছেলেমেয়েরা এখন পুরস্কার পাচ্ছে গণিত আর বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে; কৃষি বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন একের পর এক উন্নত প্রজাতির ধান, মাছ। দেশ এখন শুধু জামা-কাপড় বানাতেই পারদর্শী নয়, দক্ষতা এসেছে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনে। বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বড় বড় অবকাঠামো। সম্প্রতি আমেরিকার অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ব্লুমবার্গ বলেছে, বাংলাদেশের অবকাঠামোর যে উন্নতি হয়েছে তার সুফল সবচেয়ে বেশি করে পাওয়া যাবে আগামী দশকের মাঝামাঝি সময়ে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি করোনাকালের আগে উঠে গিয়েছিল ৮ শতাংশের উপর। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের তথ্য মতে, মাথাপিছু আয় এখন ২,৫০৩ ডলার। প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তানের তা যথাক্রমে ২,২৭৭ এবং ১,৫৩৮ ডলার। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন “উন্নয়নের রোল মডেল”।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ইলেক্ট্রার মত নিভৃতে কেঁদেছেন কিন্তু পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেননি, প্রচলিত আইনে আর দশজন সাধারণ মানুষের মত বিচার নিশ্চিত করেছেন সপরিবারে পিতৃহত্যার। সমসাময়িক কালেও অনেক উল্লেখযোগ্য নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের কন্যারাও পরবর্তীতে রাজনীতিতে এসেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সুকর্ণর কন্যা, মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী; চিলির প্রতিষ্ঠাতা সালভাদর আলেন্দের কন্যা ইসাবেল আলেন্দে; মিয়ানমারের অং সানের কন্যা, অং সান সূচী; পাকিস্তানের ভুট্টোর কন্যা, বেনজীর ভুটো; কঙ্গোর স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক পেট্রিস লুমুম্বার কন্যা, জুলিয়ানা আমাতো লুমুম্বা। এঁদের কেউই শেখ হাসিনার পর্যায়ে উঠে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারেননি; পারেননি পিতা হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে; দেশকে বদলে দিতে। মহাকাব্যের নায়িকা ইলেক্ট্রাও পারেননি দেশকে এগিয়ে নিতে। শেখ হাসিনা অনন্য। তাঁর মত পরিবারের হত্যাকারীদের এবং দেশের মানুষের উপর যুদ্ধাপরাধ সংগঠনক ও গণহত্যাকারীদের আদালতে বিচার নিশ্চিত করে, আইনের শাসন কায়েমের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নেতা শুধু আধুনিক পৃথিবীতেই নয়, পুরাণে, মহাকাব্যেও পাওয়া যায় না। শেখ হাসিনা প্রকৃত অর্থেই অতুলনীয়, অনন্য।
শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশেরই নন, সমগ্র বিশ্ববাসীর নেতায় পরিণত হয়েছেন। ইউরোপ যখন সিরিয়ান শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের সীমান্ত থেকে শিশু-নারী-বয়স্ক মানুষদের তাড়িয়ে দিয়েছে ঠিক তার পরপরই নিজেদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় এবং তাদের ভরণ-পোষণের দ্বায়িত্ব নিয়ে আরেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এ মহৎ কর্মের প্রশংসা করতে গিয়ে বিশ্ববাসী তাঁকে “মানবতার মা” অভিধায় ভূষিত করেছে। এছাড়াও জলবায়ু সঙ্কট, করোনা ভাইরাস মোকাবেলাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সঙ্কটে তিনি কাজ করছেন বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে নিয়ে। বিশ্বের কয়েকশ কোটি নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন আমাদের নেতা শেখ হাসিনা। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা শেখ হাসিনার যুগে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে সমকালীন মানুষেরা তাদের পাশের বড় মানুষটির, মহান মানুষটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। আমাদের মধ্যেও অনেকে তা পারছে না। তাতে থেমে থাকবে না সমকালের সকল মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়া আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার এই পথ চলা।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শুধু দেশের এবং বিশ্বমানবের নেত্রীই নন, তিনি একজন মা-ও বটে। তাঁর এবং বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা, শেখ রেহানার সন্তানেরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে উঠেছেন। তাঁদের শিক্ষা এবং কর্মজীবন দেশের সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। তাঁদের দ্বারা উপকৃত হচ্ছে বিশ্ব মানব। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আন্তর্জাতিক মানের কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ডিজিটাল বাংলাদেশর রূপকার। দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্বখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। আরেক দৌহিত্রী টিউলিপ সিদ্দিক তরুণ বয়সেই পরপর দুই বার নির্বাচিত হয়েছেন বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে; অধিষ্ঠিত হয়েছেন ছায়ামন্ত্রীর পদে। অপর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক নীরবে কাজ করছেন দেশের উন্নয়ন নিয়ে, গবেষণা করছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে যারা চলেন তাঁদের প্রাপ্তিগুলো এমনই হয়। তাঁরা যেখানে হাত রাখেন সেখানেই সোনা ফলে। এই লেখা শেষ করতে চাই বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টর অব ল’ ডিগ্রির সম্মাননা পত্রে শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা আরেকটি উক্তি দিয়ে, “মহান পিতার সুযোগ্য কন্যা, উপযুক্ত জনগণের সুযোগ্য সেবক”। ২৮ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন। দীর্ঘতম হোক বঙ্গবন্ধু কন্যার এই পথ চলা! কায়মনে এই প্রার্থনাসহ তাঁর প্রতি রইল ৭৬তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা! শুভ জন্মদিন, মহান নেত্রী শেখ হাসিনা।
লেখকঃ দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ