বিবিসি বাংলা: গত বছর থেকেই ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে জ্বলন্ত উনুন হয়ে আছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। এমন পরিস্থিতিতে একই সঙ্গে কয়েকটি ফ্রন্টে ইরানপন্থিদের হামলার জবাবে ১ এপ্রিল তেহরানকে সতর্ক করতে দামেস্কের ইরানি দূতাবাসে হামলা চালিয়ে বসে তেলআবিব, পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় রোববার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তেহরান। পাল্টা এ হামলার কড়া জাবাব দেওয়ার কথা জানায় ইরাসয়েলি সামরিক বাহিনী। তারপরই বৃহত্তর যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের স্পষ্ট অবস্থান জানায় ইরান।
শনিবার রাতে অপারেশন ট্রু প্রোমিজ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে ইরান। এ প্রতিক্রিয়া সীমিত ও নির্ধারিত হবে বলেও জানায় ইরানি কর্মকর্তারা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান কী করতে সক্ষম তার সামান্য চিত্র দেখাল মাত্র। এটা এমন একটি দৃশ্য যা কখনো কেউ দেখেনি।
তবে বর্তমানে ইরানের হামলার জবাব ইসরায়েল কীভাবে দেবে, সেটার ওপরই নির্ভর করছে চলমান সংঘাত কোন দিকে গড়াবে। বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার জানান, মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশ্বের অন্যত্রও বহু দেশ এই পরিস্থিতিতে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছে। এর মধ্যে এমন অনেক দেশও আছে, যারা ইরানের সরকারকে ঘোরতর অপছন্দ করে। কিন্তু এখন তারাও চাইছে ইসরায়েল যেন নতুন করে এই হামলার জবাব দিতে না যায়।
অন্যদিকে ইরানের মনোভাবটা অনেকটা এই ধরনের: ‘অ্যাকাউন্ট সেটলড – মানে শোধবোধ হয়ে গেছে। ব্যাস, বিষয়টার এখানেই ইতি টানলেই ভালো।’ ইরানের মানসিকতা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, তবে হ্যাঁ, যদি আবার আমাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানে ইসরায়েল সেক্ষেত্রে আমরা অনেক শক্তিশালী হামলা চালাব। যেটা প্রতিহত করা তোমাদের সাধ্যে কুলোবে না।
বিবিসির পার্সিয়ান বিভাগও বলছে, গত রাতের হামলার পরিণতিতে ইরানের কর্তৃপক্ষ তো বটেই, দেশের সাধারণ মানুষও বেশ খুশি। তেহরানের রাস্তায় নেমে তারা উল্লাসও করেছেন। ইসরায়েল যদি নতুন করে আর হামলা না-চালায়, তাহলে ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়া ভালো। এমন একটা মানসিকতাও তেহরানে কাজ করছে। কিন্তু ইসরায়েল ইতোমধ্যেই ‘রীতিমতো কড়া জবাব’ দেয়ার অঙ্গীকার করে বসে আছে।
ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে এই মুহুর্তে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তাকে অনেকেই সেদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘কট্টরপন্থী’ বা হার্ডলাইন সরকার বলে বর্ণনা করে থাকেন। গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের চালানো অতর্কিত হামলার জবাব দিতে ইসরায়েল সময় নিয়েছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তবু ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা একটানা গাজা ভূখণ্ডে তীব্র অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গাজাকে যেন তারা প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে।
ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার মনে করেন, ইসরায়েলের ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’ বা যুদ্ধ-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা ইরানের এই প্রত্যক্ষ হামলার কোনও জবাব না-দিয়ে হাত গুটিয়ে থাকবে। এই সম্ভাবনা আসলে খুব ক্ষীণ। তাহলে ইসরায়েলের সামনে এখন কী কী রাস্তা বা ‘অপশন’ খোলা আছে?
প্রথমত, হতে পারে তারা ওই অঞ্চলে তাদের প্রতিবেশীদের কথায় আমল দেবে এবং একটা ‘স্ট্র্যাটেজিক পেশেন্স’ বা ‘কৌশলগত ধৈর্য প্রদর্শনে’র রাস্তায় হাঁটবে। এর অর্থ হলো, সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে কোনও পাল্টা হামলা না-চালিয়ে তারা ওই অঞ্চলে ইরানের যেসব ‘প্রক্সি অ্যালাইজ’ বা শরিকরা আছে, তাদের ওপর অভিযান চালিয়ে যাবে। এর মধ্যে আছে লেবাননের হেজবোল্লাহর মতো গোষ্ঠী কিংবা সিরিয়াতে ইরানের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ কেন্দ্রগুলো।যার বিরুদ্ধে ইসরায়েল বিগত বহু বছর ধরেই হামলা চালিয়ে আসছে।
দ্বিতীয়ত, ইরান যে ধরনের হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা ঠিক সেই রকম ‘সাবধানে ও মেপে মেপে’ (‘কেয়ারফুলি ক্যালিব্রেটেড’) হামলা চালাতে পারে। যার নির্দিষ্ট লক্ষ্য হবে ইরানের সেই মিসাইল বেসগুলো, যেখানে থেকে গতরাতের হামলা চালানো হয়েছিল। তবে ইসরায়েল যদি এই অপশনটা বেছে নেয়, তাহলে ইরান সেটাকেও ‘এসক্যালেশন’ বা যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবেই দেখবে। কারণ বহু বছরের বৈরিতা সত্ত্বেও ইসরায়েল ইতিপূর্বে কখনওই সরাসরি ইরানের ভূখণ্ডে কোনও হামলা চালায়নি। বরং তারা ওই অঞ্চলে ইরানের সঙ্গী বা প্রক্সি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে আক্রমণেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে।
তৃতীয় পথ হতে পারে ইসরায়েল যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টায় আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। ইরান যেভাবে হামলা চালিয়েছে তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী পাল্টা চালাল। সেক্ষেত্রে তারা শুধু নির্দিষ্ট মিসাইল বেসগুলোই নয়, ইরানের অত্যন্ত শক্তিশালী রিভোলিউশনারি গার্ডসের ঘাঁটি, প্রশিক্ষণ শিবির ও কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সেন্টারগুলোকেও আক্রমণের নিশানা করবে।
ইসরায়েল যদি এই শেষ দুটো অপশনের কোনোটা বেছে নেয়, তাহলে ইরানকেও অবশ্যই আবারও পাল্টা আঘাত হানার পথে যেতে হবে। আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই সংঘাতে কি আমেরিকাও জড়িয়ে পড়তে পারে? পরিস্থিতি কি এমন দাঁড়াতে পারে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন মার্কিন বাহিনী আর ইরানের মধ্যেও পুরোদস্তুর গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়? মনে রাখতে হবে, উপসাগরীয় (গালফ) আরব অঞ্চলের ছয়টি দেশেই মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আছে। এছাড়া তাদের সামরিক ঘাঁটি আছে সিরিয়া, ইরাক ও জর্ডানেও।
বহু বছরের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান যে ব্যালিস্টিক ও অন্য নানা ধরনের মিসাইলের বিপুল ভাণ্ডার তৈরি করেছে। মার্কিন এই সামরিক ঘাঁটিগুলো সেসব ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানায় পরিণত হতে পারে। ইরান দীর্ঘদিন ধরেই আর একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। তারা যদি আক্রান্ত হয় তাহলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে।
কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথটি যদি ইরান মাইন, ড্রোন ও ফাস্ট অ্যাটাক ক্র্যাফট দিয়ে বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত রুটটি অচল হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের এক-চতুর্থাংশ স্তব্ধ হয়ে যাবে। অবধারিতভাবে সেটা হবে একটা দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি। যে কারণেই বিশ্বের প্রায় সব শক্তিধর দেশ সেই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিবিসির পার্সিয়ান বিভাগের সাংবাদিক জিয়ার গোল জানান, ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ডস (আইআরজিসি) ইসরায়েলের ওপর ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালানোর পর দেশটিতে সরকারের সমর্থক বহু মানুষ তেহরানের রাজপথে নেমে এসে আনন্দোল্লাস করতে থাকেন।
মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশ ইরানের মিত্র বা শরিক হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে এবং ইরানের ভেতরেও সমর্থকদের মধ্যে আইআরজিসির গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য এই হামলা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি জানান, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে যেসব নিশানাকে লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছেন, এর মধ্যে সেদেশের নোটাম বিমানবাহিনী ঘাঁটিও (এয়ারফোর্স বেস) ছিল।
দু’সপ্তাহ আগে যে ইসরায়েলি এফ-৩৫ বিমানগুলোর চালানো হামলায় দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে সাতজন আইআরজিসি কমান্ডার নিহত হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধবিমানগুলো এই ঘাঁটি থেকেই উড়ে গিয়েছিল। মেজর জেনারেল বাঘেরি এটাও জানিয়েছেন, ইরান ‘লক্ষ্য অর্জন করেছে’ এবং অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কোনও অভিপ্রায় তাদের নেই।
তবে ইরানিয়ান প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসি ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, নতুন করে (ইরানের বিরুদ্ধে) কোনও হামলা চালানো হলে ইরান অনেক কঠোর প্রত্যুত্তর দেবে। বিবিসির সংবাদদাতা জিয়ার গোল জানান, সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে ইরানের ‘মুড’ এখন ডি-এসক্যালেশন বা উত্তেজনা প্রশমনের পক্ষেই। সেদেশের শীর্ষ সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছে তারা গত রাতের হামলার পরিণামে ‘সন্তুষ্ট’।
তাছাড়া ইরান ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা সংহত করার জন্য প্রচুর সময় দিয়েছে। তাতেও মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে, তারা নতুন করে আর কোনও হামলা চালাতে ইচ্ছুক নয়। যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানি হতে পারে। কিন্তু ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায়, তা যেহেতু কোনও একটি পক্ষের ওপর নির্ভর করছে না।তাই আপাতত সারা দুনিয়াকেই পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখতে হবে।