১৭৫৭ সাল। ২৩ জুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজদৌল্লাহর পরাজয়ের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়। ১৯০ বছর পর ইংরেজ রাজত্ব অবসানে স্বাধীন হয়েছিলাম কিন্তু মুক্তি মেলেনি।
পাকিস্তান স্বাধীনতার দুই বছর পর ঢাকার কে এম দাস লেইনস্থ ‘রোজ গার্ডেন’ মিলনায়তনে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সেই ঐতিহাসিক দিন ২৩ জুনে (১৯৪৯) আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক দিনে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করে। ইতিহাসে আওয়ামী লীগ- মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ সমার্থক।
প্রতিষ্ঠার দিন কেউ কী ভাবছিল,এই দল বাঙালির স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবে? বিশাল শক্তিশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের কবর রচনা আওয়ামী লীগের হাতে হবে?
বাঙালির গৌরব করার ভাষা আছে, সাহিত্য আছে,সংস্কৃতি আছে, আছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এই সকল অধিকারের জন্য ত্যাগ-রক্ত বিসর্জন করে ইতিহাস সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ। দুনিয়ার মধ্যে এমন কোন দল আছে, যে দল একটা জাতির গৌরব করার সব অর্জনে আছে ত্যাগ ও রক্তের বন্ধন? নেই। তাই আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন,আওয়ামী লীগ একটি দল নয়, অনুভূতির নাম। এই দলের নেতা কর্মীদের রক্ত স্বাধিকার হতে স্বাধীনতা যুদ্ধে মিশে আছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবার, চার জাতীয় নেতাসহ অনেক নেতা-কর্মীর রক্ত এই দলের সাথে মিশে গেছে। এটি একটি অনুভূতি।
ক্ষমতার বাইরে থেকে স্বাধিকার হতে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘স্বাধীনতা’ এনে দিলেন ‘আওয়ামী লীগ’।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস চর্চা মানে বাঙালির ইতিহাস চর্চা। যারা আওয়ামী লীগের ইতিহাস চর্চা করে না তারা বাঙালির গৌরবের ইতিহাস চর্চা করে না। আওয়ামী লীগ নেই মানে বাঙালির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য অর্থনীতি স্বাধীনতার ইতিহাস নেই। আওয়ামী লীগ ইতিহাসের অধ্যায়। ইতিহাসের পাতা ছেঁড়া যায় কিন্তু মুছা যায় না।
আওয়ামী লীগ পরগাছা দল নয়,জনগণের শক্তিতে বলিয়ান। বড় কোন নেতার শক্তির উপর নির্ভরশীল দল নয়। অনেক বড় বড় নেতা দলটি ভাংতে চেয়েছিলেন,দুর্বল করতে চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়নি উল্টো তারা নিঃশেষ হয়ে গেছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠন করে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে চেষ্টা করেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফাকে কেন্দ্র করে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে গণআজাদী লীগ প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চেষ্টা করেন। অথচ এই দুইজন মাওলানা ছিলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম ও দ্বিতীয় সভাপতি। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন,দুইজনের সাথে সাধারণ সম্পাদক।
আইউব খানের সামরিক শাসনামলে বঙ্গবন্ধু যখন জেলে বন্দী তখন সালাম খান, জহির উদ্দিন খান প্রমূখ নেতা দ্বারা আওয়ামী লীগ ভেঙে পি ডি এম পন্থী আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে।তখন কর্মীরা জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে দলকে এগিয়ে নেয়। স্বাধীনতা পর সিরাজুল আলম খানসহ কত মেধাবী তরুণ নেতা জাসদে যোগ দেয় তার ইয়ত্তা ছিল না। ১৯৮৯ সালে মহিউদ্দিন আহমদ ও আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে বাকশাল গঠন করেন। একই সময় মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ (মিজান) গঠন করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে ড. কামাল হোসেন গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা কেউ আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে পারেননি,তাঁরা নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করেছেন। কারণ আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়,ত্যাগী কর্মীর দল।যদি নেতার দল হতো তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি খন্দকার মোশতাক সরকারের মন্ত্রীসভার ২১ সদস্যের ১৯ জনই আওয়ামী লীগার এবং বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক যোগ দেওয়ার পর এই দলের অস্তিত্ব থাকতো না। কত বড় বড় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আজ অস্তিত্বহীন।ভারতের বিশাল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘কংগ্রেস’ এখন নেতৃত্বহীন।অথচ আওয়ামী লীগ আঘাতের পর আঘাত সহ্য করে প্রতিটি আঘাতের পর নতুন শক্তিতে জেগে উঠছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্রাজেডি ও কারাগারে চার জাতীয় নেতা হত্যাকাণ্ডের মত বিপর্যয় ভারতীয় কংগ্রেসের উপর যদি আসতো তাহলে এই দলটির কী অবস্থা হতো বলা মুশকিল। কিন্তু এই মহা বিপর্যয়ের পর আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সবাই মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ আর থাকবে না,কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করবে না, কোন দিন এই দল আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না,মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ আর শোনা যাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের মৃত্যু হয়নি আদর্শিক কর্মীর কারণে।
মোস্তাক-জিয়া-এরশাদের শাসনামলে নেতারা কেনা বেঁচার পণ্য ছিল।অনেক নেতা দল ছেড়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু কর্মী বেঁচা কেনার মাল ছিল না। কারণ এই দলের মূল শক্তি কোন নেতা বা সামরিক শক্তি নয়, নিঃস্বার্থ কর্মী। বঙ্গবন্ধু বলতেন,আওয়ামী লীগের নীতি আছে,কর্মী আছে,প্রতিষ্ঠান আছে। সখের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না।
দুনিয়ার ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের শ্রম ত্যাগ রক্ত অধিক বিসর্জনের কারণে এই দলের কর্মীদের দেশপ্রেম অধিক থাকে। দেশের প্রতি অনুরাগী কর্মীর কারণে এই সব দলের মৃত্যু হয় না এবং দলের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দীর্ঘায়িত হয়।
আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার দল, তাই বেঁচে থাকবে। আওয়ামী লীগ বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে, একাত্তর বাঁচবে। এই দল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ কোনদিন পাকিস্তান হবে না।
এই দলের বিরুদ্ধে যুগে যুগে নানা ষড়যন্ত্র, অত্যাচার নেমে আসার পরও মাত্র ২২ বছরের মধ্যে একটি রাষ্ট্র উপহার দেওয়া এবং সত্তর বছর দলটি ঠিকে থাকা এক বিস্ময়। একটি অসামরিক রাজনৈতিক দল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে একটি রাষ্ট্র উপহার দেওয়া ইতিহাসে বিরল।
যখনই আওয়ামী লীগ বিজয় হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তখনই দেশ ও দেশের মানুষ লাভবান হয়েছে। এই দল শুধু দেশ দেননি,অর্থনৈতিক উন্নয়নও দিয়েছে।বড় বড় কাজ করেছে, যা অন্য কোন সরকার করতে পারেনি। অথচ আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা ও দলের কর্মীদের উপর সবচেয়ে বেশী আঘাত এসেছে। ভবিষ্যতেও আসতে পারে। আঘাত হতে বাঁচতে হলে প্রকৃত দলীয় কর্মী সৃষ্টি করতে হবে। শত শত আওয়ামী লীগের সফলতার মধ্যে একটি ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছি, তাহলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর একুশ বছর যখন এই দল ক্ষমতার বাইরে ছিল,তখন দল অনেক শক্তিশালী ছিল।দলীয় কর্মীরা তখন বন্দুক কামানের সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করতো না। আজ এই দল অনেক বছর ধরে ক্ষমতায় কিন্তু সেই দুঃসময়ের কর্মী বাহিনী কী আমরা সৃষ্টি করতে পারছি? এই ব্যর্থতা দলের সকলের।
এখন দেশের সবাই আওয়ামী লীগ। গাছের পাতা লতা বাগানের আগাছা সবই আওয়ামী লীগার। নৌকা এখন জাহাজ। প্রকৃত আওয়ামী লীগ কয়জন আছে? এই সরকারের হাতে সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে, হবে। যা আমরা দাবী করিনি তাও করেছে।কিন্তু দলীয় কর্মীর মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারছি না । বুকে একাত্তর ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করাতে পারছি না মনে হচ্ছে। এটি বড় আমাদের ব্যর্থতা।