কলেজশিক্ষিকা খায়রুন নাহার ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে দাবি করেছেন তার স্বামী মামুন। তার দাবি, ছয় লাখ টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম সংসারের বড় ছেলের সঙ্গে খায়রুন নাহারের মনোমালিন্য ছিল। এজন্য তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ফলে আত্মহত্যা করেন। তবে এ ঘটনাকে ‘হত্যা’ বলে দাবি করেছেন খায়রুন নাহারের স্বজনরা।
রোববার (১৪ আগস্ট) সকালে নাটোর শহরের বলারিপাড়া এলাকায় ভাড়াবাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এলাকার সাবেক কমিশনার নান্নু শেখের ছেলে তানভীর সিদ্দিকী সুজনের বাড়ির চারতলা ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। এ ঘটনায় তার স্বামী মামুনকে (২২) আটক করেছে পুলিশ।
আটক হওয়ার আগে মামুন বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু খায়রুন নাহারের পরিবার বিয়েটা মেনে নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘খায়রুন নাহার মাত্র দুদিন আগে বেতন তোলে। তার লোন থাকায় ২৭ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা কেটে নেয়। বাকি সাত হাজারের মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা তার বড় ছেলেকে দেয়। কিন্তু ছেলের দাবি, এখন তার ছয় লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু ওই টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার ছিল না। ফলে বড় ছেলের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়। এনিয়ে সে মানসিক কষ্টে ভুগছিল। তারপরই এ ঘটনা। আমি তাকে নানাভাবে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। এ কারণে সে আত্মহতা করতে পারে।’
খায়রুন নাহারের স্বামী কলেজছাত্র মামুন আরও বলেন, ‘রাত ২টার দিকে খায়রুন নাহার শ্বাসকষ্টে অসুস্থবোধ করলে আমি ওষুধ নিতে বাজারে যাই। ফিরে এসে দেখি দরজা খোলা। তখনই আমার ভেতরে আশঙ্কা ভর করে। বেডরুমে ঢুকে দেখি খায়রুন নাহার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলছে। আমি তাকে নামানোর জন্য বঁটির খোঁজে রান্নাঘরে যাই। কিন্তু বঁটি না পেয়ে গ্যাসলাইটার জ্বালিয়ে ওড়নায় আগুন ধরিয়ে দেই। ওড়না অর্ধেক পুড়ে গেলে টান দিয়ে ছিঁড়ে তার দেহ নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দেই। এরপর দৌড়ে গিয়ে নিচতলায় নাইটগার্ড নিজাম উদ্দিনকে খবর দেই। ফিরে এসে দিখি সে মারা গেছে। অনেক রাত হওয়ায় আমি পাশের ফ্ল্যাটের কাউকে ডাকিনি।’
নাইটগার্ড নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘রাত ২টার দিকে মামুন নিচে নেমে এসে জানায় সে হাসপাতালে যাবে। তখন আমি গেট খুলে দেই। এরপর ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরেই জানায় তার বউ গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এরপর ওপরে গিয়ে শোয়ানো মরদেহ দেখতে পাই। পরে পুলিশকে জানানো হয়। এরপর পুলিশ আসে।’
শিক্ষিকা মোছা. খায়রুন নাহার গুরুদাসপুরের খুবজিপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। মামুন নাটোর এন এস সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি একই উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের পাটপাড়া গ্রামের কলেজছাত্র মোহাম্মাদ আলীর ছেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক বছর আগে ফেসবুকে শিক্ষিকা খায়রুনের সঙ্গে মামুনের পরিচয় হয়। পরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে দুজন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বরে কাউকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করেন তারা। ছয় মাস পর বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়। তবে মামুনের পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি।
এর আগে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় একজনের সঙ্গে বিয়ে হয় খায়রুন নাহারের। তবে পারিবারিক কলহে সেই সংসার বেশিদিন টেকেনি। প্রথম স্বামীর ঘরে তার বড় ছেলে বৃন্ত। ছোট ছেলে বিম গুরুদাসপুর পৌর এলাকার খামার নাচকৈড়ে নানার বাড়িতে।
এর আগে খায়রুন নাহার বলেছিলেন, ‘প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। সেই সময় ফেসবুকে মামুনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে ভালোবাসা হয়। তারপর দুজন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করেন।’
এদিকে খায়রুন নাহারের চাচাতো ভাই ইউনুস আলী অভিযোগ করে বলেন, ‘মামুন ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে বেড়ার বাড়ি বিল্ডিং বানিয়েছে। পুরো টাকা দিয়েছে আমার আপু নাহার। এ কারণে তাকে এনজিও থেকেও লোন নিতে হয়েছে।’
খালাতো ভাই নাইমের অভিযোগ, বিয়ের পর খায়রুন নাহার মামুনকে দুটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। তিনি আবার আরটিআর মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। এসব কারণে পারিবারিক বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হতে পারে।
ঘটনার বিষয়ে খায়রুন নাহারের আরেক আত্মীয়ের ভাষ্য, ‘সে (খায়রুন নাহার) একজন অধ্যাপিকা। তার দুটি সন্তান রয়েছে। তাহলে সে আত্মহত্যা করতে যাবে কোন দুঃখে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাটোর হাসপাতালের একজন আয়া জানান, খায়রুন নাহারকে মাঝে মধ্যেই শ্বাসকষ্টজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হতো। তখন তাকে অক্সিজেন দেওয়া লাগতো।
তিনি বলেন, “খায়রুন নাহার তাকে জানিয়েছেন তার স্বামী তাকে খুবই ভালোবাসেন। শ্বশুর-শাশুড়ি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কষ্ট একটাই ছোট ছেলে আমাকে ‘মা’ বলে ডাকে না। তিনি কেবল কাঁদেন। এমন মায়ের মৃত্যু আমার কাছে খুব কষ্টের।”
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বড় ছেলেকে মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে মামুন ও খায়রুন নাহারের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। পরে রাত ২টা ১৭ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়ে যান মামুন। এরপর ফেরেন ভোর ৬টায়। এর মধ্যে সাড়ে ৩টার দিকে মামুনকে ফোন দেন খায়রুন নাহার। তাদের মধ্যে ৩৯ সেকেন্ড কথা হয়। ওই সময় মামুন জেলা কারাগারের সামনে ছিলেন।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নাটোর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ফ্যানের সঙ্গে আগুন দিয়ে পোড়ানো ওড়নার অংশ বিশেষ দেখা গেছে। সবকিছু দেখে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যাই মনে হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘অসম বিয়ের কারণে কলিগ, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতজনদের অসহযোগিতা তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনায় কাজ করতে পারে। তবে পুলিশের একাধিক টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। আমরা আশা করছি দ্রুতই সঠিক কারণ জানা যাবে।’