বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে।
দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা উঠে গেছে। একইসঙ্গে পেট্রোলের দাম ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০ টাকায়। এছাড়া অকটেনের দাম ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে লিটার প্রতি ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। যা এরই মধ্যে বাড়তে থাকা নিত্যপণ্যে বাজারে এ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সরকার বলছে, বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজার বিবেচনায় তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তাহলে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেলের দাম কত?
সরকারের ভাষ্যমতে, সরকার সব সময় জনগণের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করে নাই। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই জ্বালানী তেলের মূল্য এডজাস্টমেন্টে যেতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উর্ধ্বগতির কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ সহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত তেলের মূল্য সমন্বয় করে থাকে। বাংলাদেশে কলকাতার তুলনায় ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ৩৪.০৯ এবং পেট্টোল লিটার প্রতি ৪৪.৪২ টাকা কমে বিক্রয় হচ্ছিল। মূল্য কম থাকায় তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।
এশিয়ার অনান্য দেশ যেমন –
নেপালে ডিজেল ১২৭ টাকা, ইন্দোনেশিয়া ১৩৮, সিঙ্গাপুর ১৮৯ টাকা, চীন ১১৮ টাকা, আরব আমিরাত ১২২.৮০ টাকা ও হংকং এ ২৬০ টাকা।
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য রি-এডজাস্টমেন্ট করবে সরকার।
বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
জ্বালানি তেল আমদানিতে সর্বশেষ জুলাই’২২ মাসের গড় প্লাটস রেট অনুযায়ী বিপিসি’র দৈনিক লোকসানের পরিমাণ
ডিজেলে- প্রায় ৭৪,৯৪,৯২,৭০০.০০ টাকা ও
অকটেনে প্রায় ২,৯২,২৩,২১৬.০০
মোট- প্রায় ৭৭,৮৭,১৫,৯১৬.০০ টাকা।
সর্বশেষ মূল্য সমন্বয়ে ডিজেলের মূল্য ১১৪.০০ টাকা করা হলেও জুলাই/২০২২ মাসের গড় হিসেবে প্রতি লিটারে খরচ পড়বে ১২২.১৩ টাকা অর্থাৎ প্রতি লিটারে তারপরেও ৮.১৩ টাকা লোকসান বিপিসিকে বহন করতে হবে। এই ছিল সরকারের ভাষ্য।
পর্যবেক্ষকদের মতে, বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৮০ টাকা থেকে ১৩৯ টাকা ছাড়িয়ে যায়। মার্চে তা বেড়ে ১৫৬ দশমিক ৩ ডলারে গিয়ে পৌঁছে। তেলের এ দাম বৃদ্ধি ছিল ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ফলে ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি-জুলাই) জ্বালানি তেল বিক্রয়ের (সব পণ্য) আট হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আন্তর্জাতিক তেলের বাজারের এমন পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মূল্য সমন্বয় করা হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, আমাদের আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশে নতুন ঘোষণায় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। অকটনের লিটার ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রলের লিটার ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। ২২ মে ভারতে ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ১১৪ দশমিক ৯ টাকা এবং পেট্রলের লিটার ১৩০ দশমিক ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ দশমিক ৯ টাকা এবং পেট্রল লিটারপ্রতি ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছিল। এ ছাড়া ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকায় পাচারেরও আশঙ্কা ছিল।
বর্তমানে হংকংকে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম (বাংলাদেশি টাকায়) ২৬০ দশমিক ৭৫ টাকা ও অকটেনের দাম ২৮৪ দশমিক ৭২ টাকা, সিঙ্গাপুরে ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ১৮৯ দশমিক ৮৭ টাকা ও অকটেনের লিটারপ্রতি দাম ১৯০ দশমিক ৪৫ টাকা, পাকিস্তানের ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ১০৩ দশমিক ৭১ টাকা ও অকটেনের দাম ১০৬ দশমিক ৬৪ টাকা, নেপালের ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ১২৭ দশমিক ৮২ টাকা ও অকটেনের লিটারপ্রতি দাম ১৩৪ দশমিক ৫৫ টাকা, চীনে ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ১১৮ দশমিক ৬৩ টাকা ও অকটেনের দাম ১৩১ দশমিক ৯৯ টাকা, ভারতে ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ১১০ দশমিক ৯৫ টাকা ও ১২৩ দশমিক ৬৫ টাকা।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বাংলাদেশে ১৭ বার ডিজেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ বার বেড়েছে আর চারবার কমেছে। এর মধ্যে বিএনপির শাসনামলে বেড়েছে (২০০১-২০০৬ মেয়াদ) বেড়েছে ৯ বার। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে জ্বালানি তেলের দাম একাধিকবার কমানোর নজির রয়েছে।
২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। এর আগে ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমানো হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হতে পারে।