মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে সেনাশাসনবিরোধী মিলিশিয়াদের ঠেকাতে বিশেষ অভিযান চালিয়েছেন ক্ষমতাসীন জান্তার সেনারা। তিন দিন ধরে চলা এই অভিযানে শত শত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও বাসিন্দাদের অভিযোগ, সেনাশাসনবিরোধীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম নিশ্চিহ্ন করতেই চালানো হয় এ তাণ্ডব।
উত্তরাঞ্চলীয় স্যাগাইন প্রদেশে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সদস্যরা। দুই পক্ষের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘাতের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, পিডিএফ সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করতে গত মাসের শেষের দিকে প্রদেশের কিন, আপার কিন ও কে তাউং গ্রামে অভিযান চালান সেনারা। অভিযানে এসব গ্রামের শত শত বাড়িতে আগুন দেন তাঁরা।
কিন গ্রামের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গত ২৬ মে জান্তা সেনারা তাঁদের গ্রামে প্রবেশ করেন। এ সময় সেনারা ফাঁকা গুলি ছোড়েন। গ্রামবাসী ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পুরো রাত কাটাতে হয় আমাদের। পরদিন সকালে দেখতে পাই, গ্রামের আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। আগুন জ্বলছে। দুই শতাধিক বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমার নিজের বাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু কংক্রিটের কাঠামো টিকে আছে।’
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে এসব অভিযানে হতাহতের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। মিয়ানমারে এখন শান্তি বিরাজ করছে।
জান্তার অভিযানের পর ড্রোন থেকে ধারণ করা ওই গ্রামের কিছু ভিডিও ফুটেজ এএফপির হাতে এসেছে। ভিডিওতে গ্রামের আকাশে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু বাড়িতে তখন আগুন জ্বলছিল। অনেক ভবনের শুধু কলামগুলো রয়ে গেছে। বাকি সব পুড়ে গেছে। কে তাউং গ্রামের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তবে এসব ভিডিওর সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
কে তাউং গ্রামের বাসিন্দা আয়ে তিন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সেনারা অভিযান চালিয়ে আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছেন। আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি তাঁরা গ্রামের ঘাটে থাকা মোটরচালিত নৌকাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছেন। এসব নৌকা আমরা মানুষ ও শস্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার করতাম।’
এর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েছেন জান্তা সেনারা। ঘটেছে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা-ধর্ষণের ঘটনা। জান্তার নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে বিভিন্ন সময়ে ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা স্যাটেলাইট থেকে তোলা মিয়ানমারের কে তাউং ও কিন গ্রামের কিছু ছবি সরবরাহ করেছে। গত মাসের শেষ দিকে এসব ছবি তোলা হয়েছে। নাসার ছবিতেও গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জান্তার সেনারা এর আগেও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে পিডিএফ সদস্যদের দমনে অভিযান চালিয়েছেন, করেছেন অগ্নিসংযোগ। পিডিএফ সদস্যদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে জান্তা সরকার। গত বছরের সেনা অভ্যুত্থানের পর জান্তার সঙ্গে পিডিএফ সদস্যদের সংঘাতের ঘটনা অনেকটাই বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে তাঁদের দমনের নামে জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন।
জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে এসব অভিযানে হতাহতের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। মিয়ানমারে এখন শান্তি বিরাজ করছে।’
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। গ্রেপ্তার করা হয় সু চিসহ দেশটির বেসামরিক নেতৃত্বকে। তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো বিচারাধীন।
অভ্যুত্থানের পরপর জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো মিয়ানমার। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য, চলমান সেনাশাসনের অবসান ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, অভ্যুত্থান-পরবতী সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১ হাজার ৮০০ জনের বেশি নিহত ও ১৩ হাজারের বেশি মানুষ আটক হয়েছেন। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে দেশটিতে দেখা দিয়েছে চরম মানবিক সংকট।
অধিকার গ্রুপগুলোর দাবি, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারজুড়ে জান্তার হাতে বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বেসামরিক লোকজনের ওপর বিমান হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। জান্তা ও সেনাশাসনবিরোধীদের সংঘর্ষ এবং জান্তার অভিযানের কারণে দেশটিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ইউএনওসিএইচএ)।
এর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েছেন জান্তা সেনারা। ঘটেছে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা-ধর্ষণের ঘটনা। জান্তার নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে বিভিন্ন সময়ে ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।