সাগর রুনি হত্যা রহস্য নিয়ে দেশের মিডিয়া সহ রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নানান মহল যে যার মতো করে পরিস্থিতি ঘোলা করেছেন। পুলিশ RAB এই মামলার তদন্ত শেষ করতে কতবার সময় নিয়েছে সেটিও দেশেবিদেশে একটি মুখরোচক আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের এসব তদন্ত কর্তৃপক্ষ এতটা অদক্ষ নিশ্চয় নয়। বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরাও নিশ্চয় যথেষ্ট দক্ষ।
দেশের প্রধান সব আইনশৃংখলা বাহিনী যদি এতই অদক্ষ অথবা উচ্চতর কোন অজ্ঞাত কর্তৃপক্ষের ইশারায় যদি এই হত্যাকান্ডের রহস্য লুকিয়ে থাকে সাংবাদিকরা কী করেছেন? এ প্রশ্নটি কেউ করেছেন কী? আওয়ামী লীগ আমলে দেশের সুবিধাভোগী সাংবাদিকদের বড় অংশের মুখেরও কলরবের শিরোনাম এখন ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা!’ কথিত ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা’ ক্ষমতায় এবং দেশে নেই একমাসের বেশি সময়। এরপর থেকে এত রিপোর্ট সবাই করছেন, টকশোগুলো ফাটিয়ে ফেলছেন, নিজেদের দুই সহকর্মীর চাঞ্চল্যকর হত্যা রহস্য নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে তাদের এত অনীহা কেনো?
আমি এ নিয়ে যতটা জানার চেষ্টা করেছি তাতে মনে হয়েছে, তদন্ত কর্তৃপক্ষ তাদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের সারসংক্ষেপ তৈরি করেছিল। ডক্টর মহিউদ্দিন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় একটি সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কেউ কেউ সেই সংবাদ সম্মেলনে ক্ষিপ্ত হয়ে সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মারতেও উদ্যত হন! কারন সেই সাংবাদিকরা মনে করেছেন এ লাইনে কোন চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা হলে তা প্রকাশ হলে তাতে সাংবাদিক সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে! কারন হত্যাকান্ডটি নিয়ে দেশজুড়ে বিশেষ একটি আবেদনের সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকের ধারনা সাংবাদিকরা তাদের মতো করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন চাইছেন দেখে তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও সেখানে থেমে যান। সরকারও আর এ নিয়ে সাংবাদিক সমাজকে ক্ষিপ্ত করতে চায়নি। রুনির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও ব্যক্তিগত একটি মায়ার সম্পর্ক ছিল। কারন রুনি প্রধানমন্ত্রী বিট করতো। অথচ দেশজুড়েই বিশেষ একটি ধারনার সৃষ্টি হয় যে সরকারি কোন স্বার্থে তারা তদন্ত নিয়ে লুকোছাপা করছে!
সাগর ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। সাগর যখন মিডিয়ায় মাত্র এসেছে বড় কোন পত্রিকায় কাজ করতোনা তখন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। একটি দৈনিকের ম্যাগাজিন পত্রিকার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে রিপোর্ট করতে গেলে সেখানে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। দৈনিক সংবাদ তার প্রথম বড় পত্রিকা।
সংবাদ অফিসে সাগরের টেবিলে আড্ডা দিতে গেলে সম্পাদক আলতামাস কবির মজা করে বলতেন, তুমি আবার আমার সাগরকে ভাগিয়ে নিও না। সাগরের ইচ্ছায় আমি একবার তখন জনকন্ঠে তাকে নেবার চেষ্টা করি। কিনতু জনকন্ঠের তৎকালীন সিটি এডিটরের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। সাগর পরে যুগান্তর ও ইত্তেফাকে যোগ দেয়। ডয়েচে ভেলে’র বাংলা বিভাগের যোগ দিতে জার্মানিতে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে যোগ দেয় মাছরাঙা টিভিতে। তখনই খুন হয়ে যায়।
যে বিষয়টি কোন মিডিয়া রিপোর্টে দেখিনি তাহলো হত্যাকান্ডের সময়ে সাগর রুনির দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো। এটি আমি সাগরের পরিবারের কাছে শুনেছি। প্রেমের বিয়ে হলেও এমন হতেই পারে। বা যে কোন দাম্পত্য সম্পর্ক ভালোমন্দ মিলিয়েই হয়। দুজনের বয়সও ছিল কম। একাধিক বোন থাকলেও সাগর তাঁর মা-বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান। কিন্তু বিয়ের পর সে মা-বাবার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেনো এসব হয়েছে তা সাংবাদিকরা সাগরের মায়ের সাক্ষাৎকার নিলেই জানতে পারবেন। এখনও বেঁচে আছেন সাগরের মা।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে গেলে এই মা আমাকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী যখন তাকে জড়িয়ে ধরেন তখন তিনি তাঁকে (শেখ হাসিনা) কানে কানে বলেছেন, রুনির পরিবারের দিকে খেয়াল রাখবেন। তিনি কেনো জানি রুনির পরিবারকে সন্দেহ করেন। যুগান্তর একবার এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করলে রুনির পরিবার ক্ষিপ্ত হয়। তবে যুগান্তরের প্রতিবেদনে সায় আছে সাগরের পরিবারের।
জার্মানিতে প্রথম একা যান সাগর। রুনি ও তাদের সন্তান মেঘ পরে গেছেন। তখন রুনি ফেসবুকে মজার একটি স্ট্যাটাস দেন। রুনি লিখেছিলেন, মেঘ তার মা-বাবা’র বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে চাইছে। মা বৌ সাজবেন। বাবা সাজবেন বর। সেই অনুষ্ঠান অনেক ধুমধাম হবে। আমি তখন মজা করে সেখানে মন্তব্য করে লিখেছিলাম, নতুন বিয়ের হানিমুন হবে অস্ট্রেলিয়ায়। রুনি তখন জবাব দিয়ে লিখেছিলেন, আপনি যদি অস্ট্রেলিয়া যাতায়াতের টিকেট দেন তাহলে তাই হবে। রুনি তখন কেনো জার্মানি থেকে চলে এসেছিল এর একটি কারন আমাকে বলেছিলেন সাংবাদিক নাদিম কাদের। আমি তা ক্রসচেক করতে পারিনি।
খুন হবার দিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে সাগর গাড়িতে বসে আমার স্ত্রীর সংগে চ্যাট করছিল। তার একটি বই পাঠাতে সাগর আমাদের সিডনির বাসার ঠিকানা চেয়ে নেয়। এর কারনেও হত্যাকান্ডের খবরে আমরা স্তম্ভিত শোকাহত হয়েছি। সাগরের মাকে ফোন করলে তিনি বাবাগো বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। বাকরুদ্ধ আমি আর কোন কথা বলতে পারিনি। আজও সেই মায়ের কান্না থামেনি। কাঁদতে কাঁদতে মারা গেছেন রুনির মা। দুই পরিবারের দ্বন্দ্বও স্বাভাবিক হয়নি।
মাতৃস্নেহে মেঘ বড় হয়েছে সাংবাদিক ফারজানা রূপার পরিবারে। তার পড়াশুনার খরচ দিয়ে আসছিলেন ফারজানা রূপা। প্রতিদিন সকালে মেঘ ফারজানা রূপার বাসায় চলে আসতো। এখানে খেয়েদেয়ে যেত স্কুলে। ছুটির শেষে আবার চলে আসতো রূপার বাসায়। এখান থেকে রাতের খাবার খেয়ে নানির বাসায় চলে যেত। রুনির ভাইর বিরুদ্ধে সাগরের পরিবারের অভিযোগ মেঘকে তার দাদির সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
ঢাকার নবাবপুরে সাগরদের ছোটখাটো একটি বাড়ি আছে। বাড়িটি মেঘের নামে লিখে দিতে সাগরের মাকে বিভিন্ন সময়ে চাপ দেয়া হয়। মেঘের অভিভাবকত্ব কার সাগরের মায়ের না মেঘের মামার এ নিয়ে একটি মামলা চলমান আছে। সাগরের পরিবারের অভিযোগ রুনির বন্ধু সাংবাদিকরা এই দ্বন্দ্বে বরাবর রুনির পরিবারের পক্ষ নিয়েছেন। তারা প্রভাবশালী। মেঘ তার মামার সঙ্গে অংশ নিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ইউনুস সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গেও ভালোবাসার একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেঘের। রিজওয়ানা উপদেষ্টা হবার পর মেঘ তাকে অভিনন্দন জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। চেপে গেছে তাকে মায়ের মতো বড় করা ফারজানা রূপার গ্রেফতারের বিষয়টি।
অস্ট্রেলিয়ার কোন খুন বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার পর পুলিশ সেই বাড়ি বা অকুস্থলটিকে ক্রাইম সিন ঘোষনা করে ঘেরাও করে রাখে। রাসায়নিক পরীক্ষাদি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই ক্রাইম সিন এলাকার ভিতর কাউকে ঢুকতে দেয়না। লোকজনেরও অত সময় নেই যে সেখানে ঢোকার বা ভিড় করার চেষ্টা করবেন। মিডিয়ার লোকজনও ঘোষিত ক্রাইম সিনের বাইরে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট করেন। আইনে তারা কী পারেন কী পারেননা তা কঠোরভাবে মেনে চলেন মিডিয়ার লোকজন। আর বাংলাদেশে সবাই হুড়মুড় ঢুকে পড়েন অকুস্থলে! রক্তাক্ত লাশের পাশে দাঁড়িয়ে লাইভ করেন! পুলিশ ভয়ে তাদের কিছু বলতে পারেনা। এভাবে অনেক ঘটনার আলামত নষ্ট হয়ে যায়।
সাগর রুনির হত্যার বেশিরভাগ আলামতও এভাবে নষ্ট হয়েছে। শুধু শতশত সাংবাদিক নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও দলবল নিয়ে ঢুকেছেন! বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সেখানে ঢুকে সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন! এতে করে অনেক নষ্ট হয়ে গেলে রক্তমাখা দুটি ছুরি রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছে। সেই দুটি ছুরিতে কোন দুজনের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে সে রিপোর্ট আছে বাংলাদেশের তদন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে। কিনতু সাংবাদিকরা এটা মানতে চান নাই বলে সেই তদন্ত ফাইনাল রিপোর্ট ছাড়াই ওই অবস্থায় পড়ে আছে।
সাগরের পরিবারের একটি সূত্র আমাকে বলেছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ তাদের বলতে চেয়েছে, ওই দুটি হাতের ছাপ সাগর এবং রুনির। তদন্ত কর্তৃপক্ষের ধারনা রাতে বাসায় ফেরার পর কোন একটি বিশেষ কারনে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় তুমুল ঝগড়া হয়। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে দুজনে দুটি ছুরি নিয়ে আসেন। রাগের মাথায় একজন মেরেছেন আরেকজনকে। সবকিছুই ঘটেছে ছেলের সামনে। অনেকদিন বয়সজনিত কারনে ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেয়া হয়নি। পুলিশ RAB এর তদন্ত রিপোর্ট মানতে রাজি হননি সাংবাদিক নেতৃত্ব। এরপর উচ্চতর সিদ্ধান্তে বিষয়টি সেখানেই আটকে আছে। এরবাইরে যদি গোপন কিছু থাকে তা সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী রিপোর্টের মাধ্যমে বের করতে পারেন। এখন RAB এর হাতে থাকা রিপোর্টও কেউ প্রকাশ করতে কেউ বলছেননা! এ নিয়ে যে যার মতো করে রাজনীতিই করে যাচ্ছেন!
লেখকঃ ফজলুল বারী। অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক।
fazlulbari2014@gmail.com
Whatsup: +413871137